আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামিনে বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরাই উদ্বেগের কারণ। এছাড়া উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কাও।রোববার (১৪ ডিসেম্বর) নির্বাচন ভবনে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে এমন বিষয় উঠে এসেছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের ডেকেছিলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ। সেখানে আমরা তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। সামনে আমাদের কার্যক্রম এবং কৌশল কী হওয়া উচিত—সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি এবং তাদের বিভিন্ন মত শুনেছি। এখানে মূলত আপনারা জানেন, সাম্প্রতিক সময়ে একটা ঘটনা আমাদের সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে। সেটা শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলা—চোরাগোপ্তা হামলা। সেটা নিয়ে বিশাল আলোচনা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে আমরা আর বিস্তারিত বলছি না। সেখানে সেখানকার অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় সম্পর্কে আমরা অবহিত হয়েছি, যেগুলোর সঙ্গে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের স্বার্থ জড়িত।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, হাদির বিষয়ে এখানে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। সন্দেহভাজন হিসেবে যাকে শনাক্ত করা হচ্ছে, তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই একটা সখ্য (হাদির সঙ্গে) গড়ে তুলে অত্যন্ত কাছে গিয়েছেন। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যে, তার একটা অতীত আছে। পেছনে তার একটা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে এবং তার একটা অপরাধমূলক রেকর্ড আছে। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যেটা আমরা জানতে পারলাম—যেসব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে জামিন পেয়ে গেছেন। তারা সমাজে বিরাজ করছেন—সেটা নিয়ে আমাদের কী করণীয়, আমরা কথা বলেছি। আর তৃতীয় যে বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি, তা হলো—এই চোরাগোপ্তা হামলা কি কোনো বড় পরিকল্পনার অংশ, নাকি এটি কোনো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যদি বড় পরিকল্পনার অংশ হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর অতীতে—মানে তার এই পরিকল্পনা পর্যায়ে—কোনো কিছু করার অবকাশ ছিল কি না, বা সে যেভাবে ঘটনাটি ঘটিয়ে পালিয়ে গেল, সেখানে আমাদের কোনো ব্যর্থতা আছে কি না—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি আরও যে দুই-একটি ঘটনা ঘটেছে, আপনারা জানেন—দুটি উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, যদিও তা ব্যর্থ হয়েছে এবং সম্ভবত সেখানে একজন ছিল—আমরা সিসিটিভিতে যেটা দেখতে পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আজকের বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল—এই ধরনের হামলার ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, অথবা এগুলো যেন কঠোর হাতে দমন করা হয়। যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তারা যেন ধরা পড়ে। পাশাপাশি একটি বার্তা সকল বাহিনীর পক্ষ থেকে সমস্বরে এসেছে—যারা এই নির্বাচন বানচাল করার, প্রতিহত করার বা ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো চেষ্টা করবে, তারা ব্যর্থ হবে। যেখানে যতটুকু দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন, সকল বাহিনী ততটুকু দৃঢ় হবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই। নির্বাচন সময়মতো হবে এবং নির্বাচনের পথে এই ধরনের যে বাধাগুলো তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন অবগত। সরকার অবগত। আজ আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব কার্যক্রম এ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে যেসব জায়গায় আরও অধিকতর কাজ করার অবকাশ আছে, সেগুলো নিয়েও কথা হয়েছে।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমরা কিছু প্রত্যাশার কথা বলেছি—ডিটারেন্স তৈরি করার জন্য অধিক সংখ্যায় চেকপোস্ট বসিয়ে সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম সীমিত করা। সন্ত্রাসীরা এখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তাদের গ্রেপ্তার করা এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসা, অবৈধ অস্ত্রসহ হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ—যেগুলো আছে, যেগুলো আগেও বলা হয়েছে—আজ আবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে—সেগুলোর ব্যাপারে অভিযান চালানো। আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, ‘রেবেল হান্ট’ নামে যে অপারেশনটি প্রথমে হয়েছিল, তার দ্বিতীয় ধাপ গতকাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। এটি সমন্বিতভাবে চলবে। গোয়েন্দা কার্যক্রমের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে এবং এই গোয়েন্দা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল বাহিনীর গোয়েন্দা উপাত্ত যেন সমন্বয় করা হয়—সেটার ব্যাপারে কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের সীমান্ত অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা এবং সেই সীমান্ত এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে যে কিছু প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, সেটার সঙ্গে বৃহত্তর কোনো ঘটনার সংশ্লিষ্টতা আছে কি না—সেটাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমরা অবগত আছি, সতর্ক আছি। সার্বিকভাবে এই ছিল আজকের আলোচনা।
তিনি আরও বলেন, বার্তাটি খুবই স্পষ্ট—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মাঠপর্যায়ে চোরাগোপ্তা হামলার যে ঘটনাগুলো ইতোমধ্যে ঘটেছে, সেগুলোর প্রকৃতি নিরূপণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এগুলো প্রতিহত করার জন্য যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদুপরি একটি কথা বলা দরকার—যারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, আমাদের বন্ধু সেজে, তাদের ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি যারা এখন মাঠে আছেন। কারণ এই ঘটনাটি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে—আপাতদৃষ্টিতে সহযোগী সেজেই আমাদের ভেতরে নাশকতাকারী অনুপ্রবেশকারীরা থাকতে পারে। এদের হাত থেকে যদি ঘরের ভেতরে কোনো ঘটনা ঘটে যায়, এই ধরনের ঘনিষ্ঠ অবস্থানে ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে পরে হয়তো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাবে। সবারই সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, আরেকটি বিষয় আলোচনায় এসেছে—রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে, এবং এই সুযোগে সন্ত্রাসী বা নাশকতাকারীরা যেন ছাড় না পায়, সুযোগ না পায়। একইভাবে আলোচনায় এসেছে—সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য আগেভাগে দেওয়া হয়, যেগুলো এই ধরনের সন্ত্রাসীদের হয় উসকে দিচ্ছে, না হয় পালাতে সাহায্য করছে। এগুলো যেন না পায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাদির ওপর হামলা বা বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্যই ছিল—ভীতির পরিবেশ তৈরি করা। সেটিকে ব্যর্থ করার জন্যই আজকের এই বৈঠক এবং এটি সফল হতে দেওয়া হবে না। প্রার্থীরা অস্ত্রের লাইসেন্স পাবেন কি না—এমন বিষয় উত্থাপন করা হলে তিনি বলেন, কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাইবার সিকিউরিটি সেলগুলো ইতোমধ্যে কার্যকর। একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলি—সাইবার সিকিউরিটি বলতে নতুন করে কোনো স্থাপনা করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে বিদ্যমান সাইবার সিকিউরিটি কাঠামো রয়েছে, সেগুলোকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা বিশেষভাবে এখন নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। অপতথ্য সম্পূর্ণভাবে শূন্য করা যাবে না, তবে এর প্রবণতা ও বিস্তার ঠেকাতে হবে—সেটাই করা হচ্ছে। আর যাদের শনাক্ত করা যাবে, তারা আইনের আওতায় আসবে।
আগাম প্রচার নিয়ে তিনি বলেন, যারা এখনো সরিয়ে নেয়নি—আমরা রিটার্নিং অফিসারদের বলে দেব, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। আপনারা দেখেছেন, মাঠপর্যায়ে আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ইতোমধ্যে কার্যক্রমে আছেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যে চিহ্নিত অনেক সন্ত্রাসী ইতোপূর্বে আটক হয়েছিল, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তারা আবার জামিন পেয়ে বাইরে এসেছে। এদের কর্মকাণ্ড—বিশেষ করে যে ছেলেটি (হাদির ওপর হামলাকারী) এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে—সেও আইনি হেফাজতে ছিল এবং সেখান থেকে জামিন পেয়ে বের হয়েছে। সুতরাং এটি আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।

