একটি ছবিই যেন বলছে হাজার কথা। আফগান তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাক্কির দিল্লিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সামনের সারিতে বসে থাকা ভারতীয় নারী সাংবাদিকদের দৃশ্য সোমবার ভারতের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই সংবাদ সম্মেলনটি ছিল মুতাক্কির দ্বিতীয় প্রেস ইভেন্ট—প্রথমটিতে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে আফগান দূতাবাস ও তালেবান প্রতিনিধি দল।
রবিবারের (১২ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলনে মুতাক্কি ব্যাখ্যা দেন, আগেরদিন নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়া ছিল “অজান্তে ঘটে যাওয়া একটি ভুল”, কোনো পরিকল্পিত পদক্ষেপ নয়। তিনি বলেন, “প্রথম দিনের প্রেস কনফারেন্সে সময় ছিল খুব সীমিত, সাংবাদিকদের তালিকাও সংক্ষিপ্ত ছিল। ফলে কিছু ভুল হয়েছিল।”
শুক্রবারের ঘটনায় ভারতীয় সাংবাদিক সমাজ ও রাজনীতিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান উইমেনস প্রেস কর্পস (IWPC) ও নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া (NWMI) যৌথ বিবৃতিতে ঘটনাটিকে “নারী-বৈষম্যের জঘন্য উদাহরণ” আখ্যা দেয়।
তারা বলে, “ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সুরক্ষা থাকলেও ভারতের মাটিতে এই ধরনের বৈষম্য অনুমোদনযোগ্য নয়।”
বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ করে বলেন, “এই ঘটনার অনুমতি দিয়ে সরকার দেশের প্রতিটি নারীকে জানিয়ে দিল—তাদের জন্য দাঁড়াবার মতো সাহস নেই।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা আফগান দূতাবাসের ওই অনুষ্ঠানে কোনো ভূমিকা রাখেনি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার পরেই ভারত সরকার অনানুষ্ঠানিকভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং এর ফলেই দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হয়।
রবিবারের দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনকে বলা হয় “inclusive interaction”—অর্থাৎ সবার জন্য উন্মুক্ত অনুষ্ঠান। এতে নারী সাংবাদিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।
মুতাক্কিকে প্রশ্ন করা হয়, আফগানিস্তানে নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান অধিকার নিয়ে তালেবান সরকারের অবস্থান কী।
তিনি জবাব দেন, “আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী আছে, যার মধ্যে ২৮ লাখ নারী ও মেয়ে। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে নারীদের শিক্ষা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কখনো হারাম ঘোষণা করা হয়নি—শুধু স্থগিত রয়েছে।”
তবে সাংবাদিকরা এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হননি। তারা উল্লেখ করেন, ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে ১২ বছরের ঊর্ধ্বে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ, নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ সীমিত, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারী লেখকদের বই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুতাক্কি ১০ অক্টোবর ভারতে পৌঁছান, যেখানে তিনি রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে যৌথভাবে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন। রাশিয়াই এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ, যারা তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভারত যদিও এখনও তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও তারা কাবুলে একটি সীমিত কূটনৈতিক মিশন বজায় রেখেছে এবং মানবিক সহায়তাও পাঠাচ্ছে।
শুক্রবার মুতাক্কি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যিনি ঘোষণা দেন—ভারত কাবুলে তাদের দূতাবাস পুনরায় খুলবে, যা ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
রবিবারের সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের উপস্থিতি ও মুতাক্কির প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া অনেকের চোখে একটি ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
একজন ভারতীয় সাংবাদিক বলেন, “তিনি হয়তো সন্তোষজনক উত্তর দেননি, কিন্তু নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বিতীয়বার সংবাদ সম্মেলন আয়োজন—এটিই নিজেই এক প্রতীকী অগ্রগতি।”
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু,,বর্তমানবাংলা বিশেষ ডেস্ক ।

