জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রাঙ্গণে, যেখানে রাতের অন্ধকার ছিন্ন হয়ে উঠেছে বাঁশের মশালের লেলিহান শিখায়, সেখানে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর, ২০২৫) এক অদম্য মিছিলের সূচনা হলো। 'তিস্তা বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও' শিরোনামে তিস্তাপাড়ের শিক্ষার্থীরা অতিবিলম্বিত তিস্তা মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের দাবিতে মশাল মিছিল করলেন—যেন এক অগ্নিপথ, যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে রায়সাহেব বাজার ঘুরে তাঁতিবাজার হয়ে বিশ্বজিৎ চত্বরে অবস্থান করল। ছবির এই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্র: মশাল হাতে ধরা যুবক-যুবতীর ভিড়, পিছনে 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়'-এর বাসের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই, মুখে লাল-সাদা-কালোর ছোঁয়া—যা শুধু প্রতিবাদ নয়, তিস্তার শুকিয়ে যাওয়া স্রোতের বিরুদ্ধে এক অটল লড়াই। এই মিছিলে রংপুর বিভাগের ৮ জেলার শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, যারা মশাল হাতে যোগ দিয়ে তিস্তাপাড়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরলেন। তিস্তা মেগা প্রকল্প—যার খনন, বাঁধ নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ১৩০ কিলোমিটার এলাকাকে বাঁচানো যাবে—এখনও কাগজে আটকে আছে, যদিও চীনের ৬,৫০০ কোটি টাকার ঋণের প্রস্তাব সত্ত্বেও ভারতের বিরোধিতায় বিলম্ব হচ্ছে।
চত্বরে অবস্থান করে সমাবেশে উঠল কণ্ঠস্বরগুলো, যা যেন তিস্তার গভীরতায় ডুবে গেল। নীলফামারী জেলা কল্যাণের সভাপতি আজিজুল হাকিম আকাশ বললেন, “নভেম্বরের মাঝে আমাদের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন চাই। আমাদের দাবি মানা না হলে আমরা ঢাকাস্থ সব জেলার শিক্ষার্থীরা এক হয়ে কঠোর আন্দোলন শুরু করবো”—তাঁর কথায় মিশে গেল এক প্রজন্মের অধৈর্য, যা শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে কৃষকের ফসল ধ্বংসের বেদনা তুলে ধরল। জবিস্থ রংপুর জেলা ছাত্রকল্যাণের সভাপতি সোহাগ মন্ডল যোগ করলেন, “আমি পরিচয় দেই আমি সবচেয়ে অবহেলিত বিভাগ রংপুরের সন্তান। আমাদের মঙ্গা এলাকার কথা বলা হয়, আমরা মঙ্গা নই আমাদের মঙ্গা বানানো হয়েছে। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই”—তাঁর চোখে জ্বলজ্বলে অশ্রু, যেন তিস্তার বালুতে চাপা পড়া গ্রামের কান্না। জবিস্থ কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রকল্যাণের সভাপতি মিলন আহম্মদ বললেন, “৫ তারিখ পরবর্তী আমরা ভেবেছি এই ইন্টারিম সরকার ভারতীয় আগ্রাসনকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে কিন্তু এই সরকার তা করতে পারেনি। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাবো দ্রুত সময়ে মধ্যে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করে তিস্তা পাড়ের মানুষকে মুক্তি দিন। তা নাহলে দুর্বার আন্দোলন করে আমরা আমাদের দাবি আদায় করে নিব।” এই কথায় ভিড়ের মধ্যে উঠল করতালির ধ্বনি, যেন মশালের আলোয় জ্বলে উঠল এক অটল সংকল্প।
এই মিছিল যেন জবির সাথে যুক্ত হলো উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর আন্দোলনের সাথে—লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামের কৃষকের কষ্ট এখানে মিশে গেল জশোরের শিক্ষার্থীদের সংকল্পে। তিস্তা মেগা প্রকল্প, যা বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ব্যবস্থা ও জীবিকা উন্নয়নের মাধ্যমে লক্ষাধিককে বাঁচাতে পারে, এখনও ভারতের গজলডোবা বাঁধের ছায়ায় আটকে আছে। পরিবেশ ও জলসম্পদ উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের সাম্প্রতিক ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বর ২০২৫-এ শুরু হবে, কিন্তু এই মশাল মিছিল যেন সেই প্রতিশ্রুতিকে মনে করিয়ে দেয়: আর অপেক্ষা নয়, এখনই সময়। জবির এই কণ্ঠস্বর যেন এক হুঁশিয়ারি—নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বাস্তবায়ন করুন, নইলে উত্তরবঙ্গের হুঙ্কার আরও জোরালো হবে। তিস্তার এই লড়াই যেন একদিন ফলবে সোনার ফসলে—যদি দাবির এই আগুনকে শোনা হয়।

