৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়ে আফগান মাটিতে নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) স্থানীয় সময় গভীর রাতে আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে অন্তত তিনটি স্থানে এই হামলা হয় বলে দাবি করেছে তালেবান সরকার। এতে যুদ্ধবিরতি কার্যত ভেঙে গেছে বলে এক জ্যেষ্ঠ তালেবান কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা এএফপি’কে জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, “পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে এবং পাকতিকা প্রদেশে বোমা ফেলেছে। আফগানিস্তান এর প্রতিশোধ নেবে।”
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে টানা এক সপ্তাহ ধরে চলা সংঘর্ষে উভয়পক্ষের সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছিল। বুধবার দুপুরে (জিএমটি ১৩:০০) শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি সাময়িক স্বস্তি এনেছিল, তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় তা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। ইসলামাবাদ জানিয়েছিল, যুদ্ধবিরতি ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হবে, কিন্তু কাবুল জানায়, “পাকিস্তান হামলা না চালানো পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চলবে।”
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ শুক্রবার বলেন, “আমাদের সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আক্রমণ না চালাতে, যদি না পাকিস্তান আগ্রাসন করে। কিন্তু তারা তা ভেঙেছে—তাই আফগানিস্তানের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।”
গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় যখন কাবুলে কয়েকটি বিস্ফোরণের পর পাকিস্তান আফগান সীমান্তে ‘অভিযান’ চালানোর ঘোষণা দেয়। তখনই তালেবান বাহিনী দক্ষিণ সীমান্তে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায় বুধবারের আগে-পরে, যখন পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী উত্তর ওয়াজিরিস্তান জেলায় এক আত্মঘাতী হামলায় সাতজন পাকিস্তানি আধাসামরিক সদস্য নিহত হয়। পাকিস্তানি তালেবান (টিটিপি)-এর এক অংশ এই হামলার দায় স্বীকার করে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শফকত আলী খান শুক্রবার বলেন, “আফগান ভূখণ্ড থেকে কার্যক্রম চালানো জঙ্গি সংগঠনগুলো নিয়ে পাকিস্তান বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তালেবান সরকারকে আমরা সুনির্দিষ্ট ও যাচাইযোগ্য পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।”
ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে, আফগানিস্তান ‘টিটিপি’-র (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। কাবুল এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা “কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয় না।”
জাতিসংঘের আফগান সহায়তা মিশন (UNAMA) জানিয়েছে, সীমান্ত অঞ্চলে চলমান সংঘর্ষে আফগানিস্তানের দিকেই অন্তত ৩৭ জন নিহত এবং ৪২৫ জন আহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সীমান্ত শহর স্পিন বোলডাকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শত শত মানুষ স্থানীয় কবরস্থানে নিহতদের দাফনে অংশ নিচ্ছে, যাদের মধ্যে শিশুদের মৃতদেহও ছিল সাদা কাফনে মোড়ানো।
স্থানীয় বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী নানি বলেন, “এখন সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও সবাই আতঙ্কে আছে। কেউ কেউ সন্তানদের অন্যত্র পাঠানোর চিন্তা করছে।” আরেকজন বাসিন্দা নেমাতুল্লাহ (৪২) জানান, “মানুষের মনে ভয় কাজ করছে, কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে সবাই বাইরে বের হচ্ছে।”
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের এই সীমান্ত সংঘর্ষ নতুন করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছে—এই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা আবারও বাড়া কেবল রাজনৈতিক নয়, কৌশলগত ইঙ্গিতও বহন করছে।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়েই উভয়পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, কাতার ও তুরস্ক ইতোমধ্যেই পর্দার আড়ালে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা শুরু করেছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক শান্তি বৈঠক নির্ধারিত হয়নি।
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর সীমান্তে আবারও সংঘর্ষ শুরু হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। তালেবানের হুঁশিয়ারি ও পাকিস্তানের ‘প্রতিরোধ অভিযান’-এর ঘোষণা—দুই দিকের আগুনই একে অপরকে উসকে দিচ্ছে।
এক বিশ্লেষকের ভাষায়, “দুই দেশের এই পুরনো অবিশ্বাস এখন এক নতুন যুদ্ধের আকার নিচ্ছে—যেখানে হারবে সীমান্তের সাধারণ মানুষই।”

