logo
ads

রাউজানের গহিরায় বৌদ্ধ ভক্তি কঠিন চীবর দানে পূণ্যের আলোয় উদ্ভাসিত বিহার

মিলন বৈদ্য শুভ, রাউজান থেকে

প্রকাশকাল: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫২ এ.এম
রাউজানের গহিরায় বৌদ্ধ ভক্তি কঠিন চীবর দানে পূণ্যের আলোয় উদ্ভাসিত বিহার

বর্তমান বাংলা

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পশ্চিম গহিরা অংকুর ঘোনায়, যেখানে কর্ণফুলি নদীর স্রোত যেন বুদ্ধের শান্তির স্মৃতি বয়ে আনে, সেখানে জেতবনারাম বিহারে শুভ কঠিন চীবর দানের অনুষ্ঠান যেন এক অমৃতধারায় মুখরিত হয়ে উঠল। বর্ষার তিন মাসের বর্ষাবাসের পর, প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় এই দানোত্তম উৎসব—যা বৌদ্ধ ধর্মে দানের শ্রেষ্ঠতম, কঠিন চীবরের মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘের প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি ও পুণ্যার্জনের প্রতীক। হাজারো ভক্তের সমাগমে বিহারের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠল এক পবিত্র সমুদ্র, যেখানে প্রতিটি হাতে দানের আলো জ্বলে উঠল, আর বাতাসে মিশে গেল ধর্মদেশনার মধুর সুর। এই অনুষ্ঠান যেন একটি জীবন্ত উপমা—কঠিন চীবরের মতোই কষ্টসাধ্য, কিন্তু তার ফলে ফুটে ওঠে অসীম শান্তির ফুল।

অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করলেন গহিরা জেতবনারাম বিহারের অধ্যক্ষ বিদর্শনাচার্য ভদন্ত সত্যপাল মহাস্থবির—তাঁর হাতে ধূপের ধোঁয়া উঠল, যেন বিহারের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল বুদ্ধের করুণার ছায়া। শুভ আশীর্বাদক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় উপ-সংঘরাজ, ত্রিপিটক বিশারদ পশ্চিম আধার মানিক নিগ্রোধারাম বিহারের অধ্যক্ষ সদ্ধর্মবারিধি ভদন্ত প্রিয়দর্শী মহাস্থবির। তাঁর আশীর্বাদ যেন এক নির্মল জলধারা, যা ভক্তদের হৃদয়ে বয়ে গিয়ে ধোয়া দিল মায়া ও মোহের ধুলো। সভাপতিত্ব করলেন কক্সবাজার জয়সুখ বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ অভিধার্মিক সত্যভাষী ভদন্ত জ্ঞানবংশ মহাস্থবির, যাঁর নেতৃত্বে অনুষ্ঠান পেল এক অটল ভিত্তি—যেন বুদ্ধের ধর্মচক্র, যা ঘুরতে থাকলে কোনো বিঘ্ন থামাতে পারে না। প্রধান জ্ঞাতি ছিলেন উত্তর গুজরা বুদ্ধ পরিনির্বাণ বিহারের অধ্যক্ষ আবালা বম্মচারী ভদন্ত সুমেধানন্দ মহাস্থবির, যাঁর উপস্থিতি যেন বিহারে এনে দিল এক অতল গভীরতা।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন পশ্চিম গহিরা শান্তিময় বিহারের অধ্যক্ষ সংঘতিলক ভদন্ত মৈত্রীপ্রিয় মহাস্থবির—তাঁর মৈত্রীময় হাসিতে মিশে গেল ভক্তদের উদ্বেগ, যেন একটি নরম বাতাসে ফুলের পাপড়ি উড়ে যায়। মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখলেন উদীয়মান সাংঘিত ব্যক্তিত্ব ও মোগলটুলী শ্মশানভূমি শাক্যমুনি বুদ্ধ বিহারের পরিচালক ধর্মদূত ভদন্ত তিলোকাবংশ মহাস্থবির। তাঁর কথায় ফুটে উঠল বৌদ্ধ দর্শনের আলোকবর্তিকা—কঠিন চীবর দানের মাধ্যমে কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ পায় অসীম পুণ্য, কীভাবে এই দান হয়ে ওঠে দানের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। প্রধান সদ্ধর্মদেশক ছিলেন হরিহর প্রজ্ঞাবিমুক্তি অরণ্য ভাবনা কুঠিরের মহাপরিচালক অরণ্যচারী ধুতাঙ্গধারী ভদন্ত শ্রদ্ধেন্দ্রিয় স্থবির—তাঁর দেশনা যেন এক অগ্নিশিখা, যা জ্বলে উঠে অন্ধকার মিটিয়ে দেয়, আর ভক্তদের মনে জাগায় করুণা ও বিমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। বিশেষ জ্ঞাতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুরঙ্গা কুঞ্জবন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সারল্য ব্রহ্মচারী ভদন্ত দীপংকর মহাস্থবির, যাঁর উপস্থিতি যেন বিহারে এনে দিল এক সারল্যের আলো, যা সবাইকে মিলিয়ে তোলে একত্রে।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হাজারো ভক্ত-অনুরাগীর সমাগমে ছিল ধর্মীয় উৎসবের অপূর্ব আবহ। দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভক্তবৃন্দ—কেউ হাতে ফুলের মালা নিয়ে, কেউ মনে পুণ্যের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে—দান, পূজা ও ধর্মদেশনা শুনে অর্জন করলেন অসীম পুণ্য। সারাদিন বিহার প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠল বৌদ্ধ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে—পঞ্চশীল গ্রহণ, বুদ্ধ মূর্তি দান, অষ্ট পরিস্কার দান, ত্রিপিটক দান, সংঘ দানের মধ্য দিয়ে। ধর্মসভায় ভিক্ষুরা দেশনা দিলেন বুদ্ধের চার আন্তরিক সত্য নিয়ে, আর ভক্তদের মিলনমেলায় মিশে গেল হাসি-আনন্দের সুর। কঠিন চীবর দানের মূল অংশে, যেখানে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড় বুনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয় ভিক্ষুদের পরিধানের পবিত্র বস্ত্র—সেখানে ভক্তদের চোখে জমল অশ্রু, হৃদয়ে জাগল গভীর ভক্তির অনুরণন। এই দান যেন এক অদৃশ্য সেতু, যা লৌকিক জগতকে আধ্যাত্মিকতার সাথে বেঁধে দেয়, আর প্রত্যেককে মনে করিয়ে দেয়: দানের মাধ্যমে পাওয়া যায় না শুধু পুণ্য, বরং মনের অমৃত।

রাউজানের এই ছোট্ট গ্রামে, যেখানে কর্ণফুলির স্রোতের মতো বয়ে যায় জীবনের নদী, কঠিন চীবর দানের এই অনুষ্ঠান হয়ে উঠল এক জীবন্ত উদাহরণ—কীভাবে বৌদ্ধ ভক্তি একত্র করে মানুষকে, আর ছড়ায় শান্তির বীজ। ভক্তদের মুখে ফুটে উঠল আনন্দের হাসি, আর বিহারের আকাশে মিশে গেল মন্ত্রের ধ্বনি—যেন একদিন এই পুণ্যের আলো ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র বিশ্বে, মিটিয়ে দিয়ে সকল দুঃখ-কষ্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ