আহসানগঞ্জ রেলস্টেশনের ধূলিভরা প্ল্যাটফর্মে, রেললাইনের পাশে একটি কাঠের বাক্সে বসে আছেন এক মুচি। সকাল ১০:৪৫, আজ শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫—রোদের তেজে প্ল্যাটফর্ম গরম, তবু তার হাতে সুঁই-সুতোর কাজ থামে না। ছবিতে দেখা যায়, সে মাটিতে পাতা একটি কাপড়ের ওপর বসে, সামনে কাঠের বাক্সে সাজানো সরঞ্জাম—হাতুড়ি, ছুরি, সুতো, আঠা আর রঙিন বোতাম। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখে এক অপরিচিত আশা, আর পাশে ছড়িয়ে আছে জুতোর টুকরো। দূরে রেলব্রিজের লোহার গাড়ি দাঁড়িয়ে, যাত্রীদের পদধ্বনি আর ফোনের কথোপকথন ভেসে আসে—তাদের জীবনে এক ভিন্ন গতি, কিন্তু এই মুচির জীবনে শুধু নীরবতা। দ্রব্যমূল্যের উত্তোলনে পুড়ছে তার জীবন, তবু দিনশেষে হাতে আসে মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা—কখনো ৫ টাকা, কখনো ১০, বড়জোর ২০। এই তুচ্ছ আয়ে সংসার চালানোর দায়ে সে বসে থাকে, যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধে।
পোপাল রবিদাসের মতো এই মুচির জীবন ছবির মতোই স্পষ্ট। ৫৯ বছর বয়সে তার শরীরে বয়সের ভার, হাতে কাজের দাগ, আর মুখে এক অপরিহার্য হতাশা। রোদে পোড়া তার চামড়া, ঘামে ভিজে শার্ট—তবু সে কাঠের বাক্সে জুতো সেলাই করতে থাকে। “বাপের হাত ধরে এ কাজ শিখেছি,” তিনি বলেন, কণ্ঠে ক্লান্তি আর আক্ষেপ। “সমাজ ছোট চোখে দেখে, দামও ছোট দেয়। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই দায়।” তার কাঠের বাক্সটি শুধু জুতো সেলাইয়ের জায়গা নয়, যেন তার জীবনের সীমানা—যেখানে আশা আর অসহায়তা একসঙ্গে বসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, রেলের ধমক আর যাত্রীদের কোলাহলে সে কাজ করে, কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। “বাপ-দাদার জীবন এভাবেই কেটেছে, আমারও তাই। ভবিষ্যৎ? সে তো একটা মরীচিকা,” তিনি হাসেন, কিন্তু হাসিতে কোনো আনন্দ নেই, শুধু ক্লান্তির ছায়া।
পাশে বসে মানিক রবিদাস (৩৮), যার হাতে এখনো সুঁই চলে, চোখে স্বপ্নের ক্ষীণ আভাস। ছবিতে তার বসার ভঙ্গি দেখলে মনে হয়, সে দিনের পর দিন একই কাজে বাঁধা। “ছোটবেলা থেকে এই কাজ শিখেছি,” তিনি বলেন, কণ্ঠে এক অপরিহার্য গভীরতা। “অন্য কাজ শিখব কী করে? পুঁজি কোথায়? এ কাজ না করলে কে করবে? আমরা ছেড়ে দিলে জুতার সেলাই কি থেমে যাবে?” তিনি আকাশের দিকে তাকান, যেন কোথাও লুকিয়ে আছে এক সুদিনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাজারের উত্তোলন আর সমাজের উপেক্ষা তার স্বপ্নকে ছাই করে দেয়। তার কাঠের বাক্সে ছড়িয়ে আছে জীবনের ছোট ছোট টুকরো—একটি পুরনো জুতো, একটি ভাঙা সেলাই মেশিন—যা তার অসহায়তার প্রতীক।
স্টেশন মাস্টার সুব্রত কুমার প্রতিদিন দেখেন এই মুচিদের নীরব সংগ্রাম। ছবিতে তিনি দূরে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাদের জীবনের দুর্গতি তার কথায় ফুটে ওঠে। “এদের দেখে বুক ভারী হয়,” তিনি বলেন, চোখে মায়া। “এই আয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চলে কী করে? সৃষ্টিকর্তাই জানেন।” তিনি মনে করেন, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এদের জীবনের চাকা ঘুরবে না। “এদের জন্য কিছু করা উচিত—কোনো প্রশিক্ষণ, কিংবা সাহায্য,” তিনি জোর দিয়ে বলেন, যেন ছবির নীরবতাকে ভাঙতে চান।
মানবাধিকার কর্মী সিরাজ বাঁশফোর (৩৩) এই মুচিদের জীবনকে আরও গভীরভাবে দেখেছেন। “নামে মুচি, কিন্তু কাজে মহান,” তিনি বলেন দৃঢ়তার সঙ্গে। “আধুনিক সমাজে এরা পিছিয়ে পড়েছে। বাপ-দাদার পেশা আর অস্থায়ী দোকান নিয়ে ধুঁকছে তাদের জীবন।” ছবির কাঠের বাক্স আর প্ল্যাটফর্মের ধূলো তার কথাকে সমর্থন করে। তিনি আঙুল তুলে দেখান আসল সমস্যা—আধুনিক জুতার বাজারে টিকে থাকার প্রশিক্ষণের অভাব। “যুব উন্নয়ন বা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আধুনিক জুতা তৈরি বা মেরামতের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ফলে এদের কাজ মূল্যহীন হয়ে পড়ছে,” তিনি বলেন। সিরাজের দাবি, উন্নত প্রশিক্ষণ, আর্থিক অনুদান আর সরকারি সহায়তা ছাড়া এই মানুষগুলোর জীবন বদলাবে না।
রেলের ধমকে, স্টেশনের চলমান জীবনে, মুচিদের নীরব কষ্ট ছড়িয়ে আছে। ছবির প্রতিটি কোণে তাদের মানবিক কান্না ফুটে ওঠে—হাতে সুঁই চলে, কিন্তু জীবনের ফুটো সেলাই হয় না। তাদের কাঠের বাক্সে লুকিয়ে আছে একটি অতীত, যেখানে বাপ-দাদার হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই পেশা। তবু, প্রতিটি সেলাইয়ে তারা বেঁধে রাখেন একটু আশা—যদি কোনোদিন ফিরে আসে সুদিন, যদি তাদের পরিশ্রম পায় প্রকৃত মূল্য। ছবির নীরবতায় মিশে যায় তাদের জীবনের গল্প, যা শুধু চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায় না।

