logo
ads

কুবিতে মশালের আলোয় জ্বলে উঠল তিস্তার দাবি

কুবি প্রতিনিধি

প্রকাশকাল: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪২ পি.এম
কুবিতে মশালের আলোয় জ্বলে উঠল তিস্তার দাবি

বর্তমান বাংলা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) প্রধান ফটকের সামনে, যেখানে রাতের অন্ধকার ছিন্ন হয়ে উঠেছে মশালের লেলিহান শিখায়, সেখানে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর, ২০২৫) রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হলো এক অদম্য মিছিল। কুবির আঞ্চলিক সংগঠন 'উত্তরবঙ্গ ছাত্র পরিষদ'-এর উদ্যোগে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে এই মশাল মিছিল—যেন এক অগ্নিপথ, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে জ্বলে উঠল উত্তরবঙ্গের কৃষক-মানুষের কান্নার সুরে। ছবির এই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্র: বাঁশের মশাল হাতে ধরা যুবক-যুবতী, পুরুষ-মহিলা-শিশু সবাই মিলে গিয়ে এক ভিড়, পিছনে 'কলেজ'-এর লেখা দেওয়াল যেন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মিছিলে অংশ নিলেন কুবির উত্তরবঙ্গ ছাত্র পরিষদের শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা, যাদের কণ্ঠে উঠল স্লোগান: “তিস্তা বাঁচাও, দেশ বাঁচাও!”, “আমাদের তিস্তা, বুঝে নিবো হিস্যা!”, “বাঁচাও তিস্তা বাঁচাও দেশ, তোমার আমার বাংলাদেশ!”, “জাগো বাঙ্গালী কোনঠে সবাই!”—যেন প্রতিটি শব্দে মিশে গেল তিস্তার স্রোতের বেদনা, যা শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায় এবং বর্ষায় ধ্বংসের ঝড় তুলে।

এই মশালের আলোয় ফুটে উঠল সাতটি জরুরি দাবি, যা তিস্তার জীবন রক্ষার চাবিকাঠি। প্রথমত, নদী খনন ও প্রবাহ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মূলধারা গভীর-প্রশস্ত করা, যাতে শুষ্ককালে পানি ধরে রাখা যায়—কারণ, বর্তমানে ভারতের গজলডোবা বাঁধ থেকে ন্যূনতম পানি ছাড়ায় বাংলাদেশের অংশ মাত্র ১০০০ কিউসেকের নিচে নেমে যায়। দ্বিতীয়ত, রিজার্ভয়ার বা ব্যারেজের আধুনিকীকরণ এবং সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, যাতে কৃষকরা সেচনির্ভর ফসল চাষে পানির অগ্রাধিকার পায়। তৃতীয়ত, বন্যা-ভাঙন নিয়ন্ত্রণে তীরে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ, যা বছরে লক্ষাধিককে বাস্তুহারা করে না। চতুর্থত, কৃষি-মৎস্য-জীবিকা উন্নয়নে নদীভিত্তিক চিংড়ি-মাছ চাষ ও পর্যটনকে মহাপরিকল্পনার অংশ করা। পঞ্চমত, স্থানীয় কৃষকদের পানি ব্যবহারে অগ্রাধিকার। ষষ্ঠত, পরিবেশ রক্ষায় চরাঞ্চলে বনায়ন, পানি দূষণ-বালু দখল-অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ বন্ধ। সপ্তমত, বাংলাদেশ-ভারতের তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য যৌথ নদী কমিশন (JRC)-এর কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা এবং “তিস্তা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ” গঠন করে সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন। এই দাবিগুলো যেন এক অমৃতধারা, যা তিস্তাকে শুধু নদী নয়, উত্তরবঙ্গের প্রাণ করে তুলতে পারে—কিন্তু বর্তমানে চীনের সহায়তায় “তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট” (TRCMRP)-এর মাস্টারপ্ল্যান ডিসেম্বর ২০২৫-এ ফাইনালাইজ হওয়ার কথা, যদিও ভারতের বিরোধিতা এবং বিলম্বে এখনও কাজ শুরু হয়নি।

মিছিলের পর মুক্তমঞ্চে উঠল কণ্ঠস্বরগুলো, যা যেন তিস্তার গভীরতায় ডুবে গেল। নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ও কুবি শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল বাশার বললেন, “আমরা একটা যৌক্তিক দাবি নিয়ে এসেছি। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেই আসে, আমাদের নদী শাসনের হিস্যা বুঝিয়ে পাই না। এই বাংলার কৃষি যদি বাঁচাতে হয় তাহলে উত্তরবঙ্গের কৃষকদের বাঁচাতে হবে। তাই তিস্তা প্রকল্পের ন্যায়্য হিস্যা জরুরি। আমরা শুনেছি প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক লেভেলের খেলোয়াড়। তবে উনার এই খেলোয়াড়ি মনোভাব এখনো দেখতে পাইনি। আমরা চাই আপনার আন্তর্জাতিক ক্ষমতা দেখিয়ে এটার হিস্যা আদায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করবেন। আমরা সমগ্র শিক্ষার্থী আপনার পাশে আছি।” তাঁর কথায় মিশে গেল এক প্রজন্মের অস্থিরতা, যা শুধু দাবি নয়, বেঁচে থাকার লড়াই। কুবি শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মুস্তাফিজুর রহমান শুভ যোগ করলেন, “এই তিস্তা প্রকল্প শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের সমস্যা না, এটা আমাদের সম্পূর্ণ বাংলাদেশের সমস্যা। তিস্তার দুই পাড়ে যে উত্তরবঙ্গ অবস্থিত, সেইখানে যখন পানি লাগবে না তখন ভারতীয় আগ্রাসন পানি ছেড়ে দেয় আর যখন পানি লাগবে তখন আটকিয়ে রাখে। এটার সুরাহা করতে হবে।” এই কথা যেন এক তীর, যা ভারতের উজানী বাঁধের অসমতুল্যতাকে ছুঁয়ে গেল।

শিক্ষকদের কণ্ঠও যেন মশালের শিখার মতো জ্বলজ্বলে। ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ হারুন বললেন, “আমাদের উত্তরবঙ্গে এখন আগের মতো ফলন হয় না। উত্তরবঙ্গ না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না কারণ বেশিরভাগ জায়গায় উত্তরবঙ্গ থেকে সবজি যায়। ফসল ফলানোর জন্য পানির অভাবে কৃষক প্রয়োজনে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন যেটি আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ফলে সবসময় উত্তরবঙ্গের তাপমাত্রা বেশি থাকে। আমাদের উত্তরবঙ্গ সবসময় অবহেলিত ছিল। উত্তরবঙ্গ মানুষের পেট যদি ভরা থাকে তাহলে তারা শান্ত থাকবে, অন্যথায় উত্তরবঙ্গের মানুষের হুঙ্কার সহ্য করতে পারবেন না।” তাঁর কথায় ফুটে উঠল পরিবেশের ক্ষত, যা শুষ্কতায় জীববৈচিত্র্য গ্রাস করছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মোঃ সাদেকুজ্জামান যোগ করলেন, “উত্তরের অবহেলিত এই যে জনপদ সেই উত্তরবঙ্গকে আমরা শস্যভাণ্ডার হিসেবে জেনে এসেছি। হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে তিস্তা এমন একটি নদী যেটি উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। যার কারণে যেটি আমাদের ন্যায়্য হিস্যা, শুষ্ক মৌসুমে আমাদের ন্যায়্য পানিটুকু পাওয়া দরকার ছিল সে পানিটুকু পাইনি। এই দাবি উত্থাপিত হয়, এটি নিয়ে আন্দোলন হয়, রাষ্ট্র পক্ষ বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে আশান্বিত করেন এবং বলেন এর সমাধান হবে। কার্যত আমরা এর কোনো সমাধান পাইনি। আজকে যখন আমরা দেখি বাংলাদেশের ৫টি জেলা, বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী এবং লালমনিরহাট দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়। যার কারণে এটি কৃষি ব্যবস্থার ও মানুষের জীবনের একমাত্র অবলম্বন। সেই জায়গাটিতে যখন বার বার হস্তক্ষেপ হয়, সেই জায়গাটিতে যখন সরকারের কোনো সুনজর থাকে না তখন সে জায়গার মানুষকে আন্দোলনে নামতে হয়। আমরা চাই বর্তমান যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে সে সরকার আমাদের এই ন্যায়্য হিস্যার ব্যবস্থা করে দিবেন।” তাঁর কথায় মিশে গেল ইতিহাসের বেদনা, যা উত্তরবঙ্গকে শস্যভান্ডার থেকে দুর্ভিক্ষের ছায়ায় নিয়ে এসেছে।

সংগঠনের নেতৃত্বও যেন মশালের মতো জ্বলন্ত। সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান নয়ন বললেন, “তিস্তা শুধু নদী নয়, এটি উত্তরবঙ্গের প্রাণ ও বাংলাদেশের জীবনের স্পন্দন। আজ এই নদী মরছে, আর এর সঙ্গে মরছে আমাদের কৃষক, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি। আমরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে বলি—তিস্তা বাঁচাও, দেশ বাঁচাও! পানির ন্যায়্য অধিকার আমাদের প্রাপ্য, এটি কারও দান নয়। তিস্তার জলে আবার জীবন ফিরিয়ে আনাই আজ আমাদের সংগ্রামের শপথ।” সভাপতি নাইম আহমেদ যোগ করলেন, “তিস্তার সমস্যা শুধু উত্তরবঙ্গের সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের সমস্যা যার প্রমাণ দলমত নির্বিশেষে সকলের তিস্তা সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণ করেছে। এই সমস্যাটা অনেক আগে থেকে চলে আসছে। বিভিন্ন সরকার পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু এটার কোনো সমাধান হচ্ছে না। আমরা এখানে শুধু প্রতিবাদ করতে আসিনি আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাই। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তাহলেই এই সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের সরকারের কাছে অনুরোধ ৭টি দাবি মেনে নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে তফসিল ঘোষণার আগে।” এই কথাগুলো যেন এক শপথ, যা চীনের ৬,৫০০ কোটি টাকার ঋণের প্রস্তাব সত্ত্বেও বিলম্বিত প্রকল্পকে ত্বরান্বিত করার আহ্বান।

কুবির এই মশাল মিছিল যেন উত্তরবঙ্গের দূর-দূরান্ত থেকে এসে এক হয়েছে—লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামের কৃষকের কান্না এখানে মিশে গেল কুমিল্লার ছাত্র-শিক্ষকের সংকল্পে। এটি শুধু প্রতিবাদ নয়, এক জাতীয় দাবি—যেখানে তিস্তার পানি না পেলে বাংলাদেশের কৃষি-অর্থনীতি ধসে পড়বে। সরকারের কাছে এই মশালের আলো যেন এক সতর্কবার্তা: নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বাস্তবায়ন করুন, নইলে উত্তরবঙ্গের হুঙ্কার আরও জোরালো হবে। তিস্তার এই লড়াই যেন একদিন ফলবে সোনার ফসলে—যদি দাবির এই আগুনকে শোনা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ