logo
ads

জুলাই সনদ: ঐক্যের দলিল নাকি বিভেদের নতুন প্রশ্নপত্র?

হিরণ্ময় হিমাংশু

প্রকাশকাল: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪০ এ.এম
জুলাই সনদ: ঐক্যের দলিল নাকি বিভেদের নতুন প্রশ্নপত্র?

প্রতিকী ছবি

রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে প্রণীত “জুলাই জাতীয় সনদ” এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। শুরুতে একে বলা হচ্ছিল “জাতীয় ঐক্যের দলিল”—যে দলিল রাজনৈতিক বিভাজনের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি রচনা করবে। কিন্তু সনদ স্বাক্ষরের আগেই একের পর এক দল পিছিয়ে যাওয়ায় এখন প্রশ্ন উঠেছে, এটি সত্যিই ঐক্যের প্রতীক হচ্ছে, নাকি নতুন বিভেদের সূচনা করছে।

ঐকমত্যের যাত্রা, অনৈক্যের গন্তব্য:

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করে। সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও সংসদীয় সংস্কারের জন্য এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৮৪টি প্রস্তাব।

কিন্তু ১৭ অক্টোবরের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগমুহূর্তে অন্তত পাঁচটি দল জানিয়েছে তারা এই সনদে স্বাক্ষর করবে না। বামধারার চার দল—বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ—বৃহস্পতিবার এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাতটি কারণ দেখিয়ে সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিয়েছে।

তাদের অভিযোগ, সনদে সংবিধানের চার মূলনীতি (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ) বাদ দেওয়া হয়েছে, স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত তফসিল বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে, আর আদালতে প্রশ্ন তোলার অধিকার রুদ্ধ করা হয়েছে—যা রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তির পরিপন্থি।

সিপিবির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সের ভাষায়, “এই সনদের মাধ্যমে একাত্তরকে ২০২৪ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে”—এই মন্তব্যটি তাদের উদ্বেগের প্রতীক।

এনসিপির অনীহা: আইনি ভিত্তি নিয়েই সংশয়:

জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–ও স্বাক্ষর অনুষ্ঠান থেকে সরে গেছে। তাদের বক্তব্য, “আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদ কেবল আনুষ্ঠানিকতা।”

দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, সনদটির কোনো আইনি বা সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত না হলে এতে স্বাক্ষর করা অর্থহীন হবে। এনসিপি দাবি করছে, সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আইনি নিশ্চয়তা দিতে হবে।

এই অবস্থান শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে—জুলাই সনদ প্রস্তুতে অন্যতম সক্রিয় পক্ষ এখন নিজেই সরে যাচ্ছে।

বিতর্কের কেন্দ্র: ধর্মনিরপেক্ষতা, আদালতের নিষেধাজ্ঞা ইতিহাসের ব্যাখ্যা:

জুলাই সনদের সবচেয়ে আলোচিত অংশ হলো এর মূলনীতি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেখানে চার মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সেখানে জুলাই সনদে তা পরিবর্তন করে বলা হয়েছে—“সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি।”

ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে “ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি”—এই বাক্যাংশ নিয়ে অনেকের উদ্বেগ, কারণ এটি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে অস্পষ্ট করে তুলছে।

আরেকটি বিতর্ক আদালতসংক্রান্ত ধারা নিয়ে। সনদের অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, “জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না।”

অর্থাৎ, নাগরিক কেউ যদি মনে করেন সনদের কোনো অংশ সংবিধানবিরোধী, তিনি আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন না। এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই অনেক আইনবিদের মন্তব্য।

সংস্কারের প্রস্তাব: আলো সম্ভাবনা:

সব বিতর্কের মধ্যেও সনদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারপ্রস্তাব আছে, যেগুলো বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সনদে বলা হয়েছে,

ক) একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন।

খ) প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান পদে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না।

গ) সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়া হবে।

ঘ) সংসদ সদস্যরা অর্থবিল ও আস্থাবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে স্বাধীনভাবে মত দিতে পারবেন।

ঙ) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রস্তাবও এতে রাখা হয়েছে।

এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহি বাড়বে, যা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে।

দ্বিধাগ্রস্ত ঐকমত্য:

তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, যে সনদে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব, সেটি যদি বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়াই স্বাক্ষরিত হয়, তবে এর নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা কতটুকু থাকবে?

ঐকমত্য কমিশনের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ তৈরি করা। কিন্তু এখন সেই সংলাপই অনৈক্যের প্রতীকে পরিণত হচ্ছে।

অন্যদিকে, জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের উদ্যোগে প্রণীত জুলাই সনদ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও তার জোটের দলগুলো শুরু থেকেই বাইরে রাখা হয়েছে। তথ্য মতে, ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠকগুলোতে ৫২টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২১টি সংলাপে অংশ নিয়েছে, বাকি ৩১টি অংশগ্রহণ করেনি বা আমন্ত্রণ পাইনি। সংলাপে  অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে থেকে সাতটি দল [এনসিপি, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), জাসদ, গণফোরাম, রাষ্ট্র সংস্কার অন্দোলন] জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আগের দিন বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের মূলনীতির যথাযথ প্রতিফলন হয়নি। সার্বিকভাবে, সনদে অংশগ্রহণের মধ্যে মতবিরোধ থাকায় রাজনৈতিক ঐকমত্যে বাধা দেখা দিতে পারে। ফলে সনদটি কার্যত একাংশের ঐকমত্যের দলিল—যা গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিভাজনকে আরও গভীর করতে পারে।

শেষ কথা:

জুলাই সনদ নিঃসন্দেহে এক উচ্চাভিলাষী প্রয়াস—রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক সংস্কারে মৌলিক পরিবর্তনের নকশা। কিন্তু এই নকশা তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

এখন যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তাতে সনদটি ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠার বদলে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে: বাংলাদেশ কি সত্যিই একটি নতুন জাতীয় ঐকমত্যের পথে এগোচ্ছে, নাকি আরেকটি বিভাজনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে?

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ