চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ছত্রপাড়ায়, যেখানে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি যেন হৃদয়ের আলয় হয়ে ওঠে, সেখানে অধরচাঁদ গোস্বামী রাধাকৃষ্ণ সেবাশ্রমে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) এক অপূর্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের স্বরলহরী ভেসে উঠল। বিশ্ববিখ্যাত মহাত্মা শ্রীমৎ স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজের কিডনি ফেলিওরের যন্ত্রণায় জর্জরিত শরীরের আশু রোগমুক্তির কামনায় এই অনুষ্ঠান—যেন এক অমৃতধারা, যা দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজারো ভক্তের হৃদয়ে ভক্তির জোয়ার তুলে দিল। বৃন্দাবনের এই রাসিক সাধকের জন্য, যাঁর কথামৃত লক্ষ লক্ষ হৃদয়কে স্পর্শ করে, এই প্রার্থনা ছিল না কেবল আচার-অনুষ্ঠান, বরং এক গভীর আত্মিক সংযোগ—যেখানে প্রতিটি মন্ত্রে মিশে গেল অশ্রু আর আশা।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের শুরু হলো সকালের আলোয় বিশেষ প্রার্থনায়। আশ্রমের প্রাঙ্গণে, রাধাকৃষ্ণের পাদপদ্মে ফুলের আর্দ্রতায় ভেজা, ভক্তেরা সমবেত হয়ে জপ করলেন মহারাজের সুস্থতার জন্য। পৌরহিত্য করলেন হাটহাজারী মিরেরহাট চন্দ্রপুর ওঁকার জ্যোতি মঠের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী তাপসানন্দ গিরি মহারাজ—তাঁর মন্ত্রোচ্চারণ যেন এক অলৌকিক শক্তি, যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মহারাজের শরীরে স্পর্শ করতে চায়। স্বামী তাপসানন্দের হাতে ধূপের ধোঁয়া উঠল, আর সেই সাথে ভক্তদের চোখে জমল অশ্রু—কারণ, বৃন্দাবনের সেই মহাত্মা, যাঁর দৈনিক পদযাত্রা লক্ষ ভক্তের জীবনে আলো ছড়ায়, আজ ডায়ালাইসিসের যন্ত্রণায় বাঁধা। যেন এক নির্মল নদী, তুলসী দানের অনুষ্ঠানে ভক্তেরা সেই পবিত্র পাতা স্পর্শ করে কামনা করলেন মহারাজের জীবনে ফিরুক সুস্থতার সবুজ।
মঙ্গলময় গীতাপাঠের সময় যেন সময় থেমে গেল। আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ শঙ্করানন্দ মহারাজ এবং শ্রীমৎ স্বামী সমরনাথ ব্রহ্মচারীর কণ্ঠে ভগবত গীতার শ্লোকগুলো উচ্চারিত হলো—প্রতিটি শব্দে মিশে গেল ভক্তির সুর, যেন রাধার কৃষ্ণলীলার স্মৃতি। "কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন,"—এই শ্লোকের অনুরণনে ভক্তেরা অনুভব করলেন মহারাজের জীবনের দর্শন: পরিশ্রম আর ভক্তিতে বাঁধা অটলতা। গীতাপাঠের মাঝে ভক্তিসঙ্গীতের ধ্বনি উঠল, যা হৃদয়কে নাড়া দিয়ে দিল—কেউ কেউ চোখ বুজে বসে রইলেন, যেন মহারাজের সামনে দাঁড়িয়ে। এই অনুষ্ঠানে মন্দিরের উন্নয়ন ও আর্থিক সহায়তায় অবদান রাখলেন প্রবাসী শ্রী রনি দাশ, যাঁর দান যেন এক আলোকবর্তিকা, আশ্রমের পথকে আরও উজ্জ্বল করে।
অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গণে ছিলেন আশ্রম পরিচালনা পরিষদের মূল সদস্যবৃন্দ—সভাপতি সবীর শীল (সাগর), সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ দাশ, অর্থ সম্পাদক টিটু দাশ, তুষার কান্তি দাশ, মাখন দাশ, বাবু শীল, সুশান্ত দত্ত (সোনা), অরুন বিজয় দাশ, দোলন দাশ, ডাঃ সাধন দাশ, ডাঃ প্রদীপ শীল, সজল দাশ, বিটু শীল, যুগ্ম সম্পাদক সৌভর দাশ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুমন দাশ সহ সকলে। তাঁদের মুখে ছিল উদ্দীপনা, চোখে ভক্তির জ্যোতি। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন রাউজান ঐক্যবদ্ধ সনাতনী সমাজের সদস্য ভোমর দাশ এবং সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের সভাপতি শ্রীমান দাশ (শুভ)—তাঁদের উপস্থিতি যেন এই অনুষ্ঠানকে আরও বিস্তৃত করে তুলল। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল আশ্রম পরিচালনা পরিষদ, যাঁরা এই আয়োজনকে একটি স্মৃণীয় মুহূর্তে রূপ দিলেন।
দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজারো নারী-পুরুষ ভক্তবৃন্দের সমাগমে প্রাঙ্গণ যেন এক ভক্তির সমুদ্র হয়ে উঠল। কেউ এলেন দাদার হাত ধরে, কেউ নিজের স্বপ্নের আলোয়—সবাই একই কামনায়: মহারাজের সুস্থতা। দিনের শেষে মহাপ্রসাদ বিতরণের সময় যেন হৃদয়ে নামল শান্তির বৃষ্টি; প্রতিটি হাতে প্রসাদ নিয়ে ভক্তেরা অনুভব করলেন এক অদৃশ্য স্পর্শ—যেন মহারাজ নিজে তাঁদের মাঝে। এই অনুষ্ঠানে গীতাপাঠ, ভক্তিসঙ্গীত আর প্রার্থনার মিশেলে সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর ধর্মীয় অনুরণন, যা ভক্তদের হৃদয়ে ভক্তিময় আবহ নিয়ে এসেছে। যেন একটি ফুলের পাপড়ি, এই অনুষ্ঠান মহারাজের জীবনে সুস্থতার আশা ছড়াল—আর সেই আশায় রাউজানের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

