logo
ads

আসাদের ‘পরিষ্কারক অভিযান’: মরুভূমির বালুর নিচে চাপা মানবতার আর্তনাদ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশকাল: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২০ পি.এম
আসাদের ‘পরিষ্কারক অভিযান’: মরুভূমির বালুর নিচে চাপা মানবতার আর্তনাদ

ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে ধুমায়ের মরুভূমি—দেখতে সাধারণ, শুষ্ক ও নিস্তব্ধ। কিন্তু এই নির্জন মরুভূমির বুকেই লুকিয়ে আছে এক বিভীষিকাময় ইতিহাস। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স সম্প্রতি আবিষ্কার করেছে, এখানে বিশাল এক গণকবর তৈরি হয়েছিল স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ আমলে, যেখানে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিককে গোপনে কবর দেওয়া হয়।

এই গোপন পরিকল্পনার নাম ছিল “অপারেশন মুভ আর্থ”—একটি ভয়ঙ্কর মিশন, যার লক্ষ্য ছিল পুরনো গণকবর থেকে লাশ সরিয়ে নতুন, দূর মরুভূমিতে পুঁতে ফেলা, যাতে আসাদের আমলের নির্যাতন ও গণহত্যার প্রমাণ চিরতরে মাটিচাপা পড়ে যায়।

২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সপ্তাহে চার রাত, ছয় থেকে আটটি ট্রাক চলত দামেস্কের উপকণ্ঠের কুতাইফাহ নামের শহর থেকে। ট্রাকগুলো ভর্তি থাকত মাটি, পচা মাংস আর হাজারো মৃতদেহে। চালক ও মেকানিকদের দেওয়া হতো কঠোর নির্দেশ—কেউ কথা বলবে না, কেউ গাড়ি থেকে নামবে না, কারও সঙ্গে কিছু বললে মৃত্যু নিশ্চিত।

এক সাবেক রিপাবলিকান গার্ড কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, “আমাদের বলা হয়েছিল, দেশকে পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু সেই পরিষ্কার মানে ছিল মৃতদেহ সরানো।”

পুরনো গণকবর কুতাইফাহ এলাকায় ছিল। ২০১২ সাল থেকেই সেখানে বন্দিশিবির, জেরা কেন্দ্র ও যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতদের লাশ পুঁতে রাখা হতো। মানবাধিকারকর্মীরা ২০১৪ সালে সেই গণকবরের অস্তিত্ব প্রকাশ করলে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
এরপরই প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে আসে নির্দেশ—“সব প্রমাণ গায়েব করে দাও।”

রয়টার্স তদন্তে উঠে এসেছে, এই গোটা অভিযান পরিচালনা করেছিলেন কর্নেল মাজেন ইসমানদার, যিনি সরকারে পরিচিত ছিলেন “মাস্টার অব ক্লিনজিং” নামে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লাশ স্থানান্তর। ট্রাকের কাফেলা রাতে কুতাইফাহ থেকে রওনা হয়ে ধুমায়ের মরুভূমির দিকে যেত। প্রতিবার ট্রাকগুলো ভর্তি থাকত অর্ধপচা দেহ, কঙ্কাল আর মাটি।

একজন চালক বলেন, “আমি শুধু গাড়ি চালাতাম। ট্রাকে কী আছে জানতাম, কিন্তু কিছু বললে মৃত্যু নিশ্চিত।”

রয়টার্সের স্যাটেলাইট ছবি, ড্রোন চিত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে জানা গেছে—ধুমায়ের মরুভূমিতে তৈরি হয়েছে অন্তত ৩৪টি লম্বা ট্রেঞ্চ বা গর্ত, যার মোট দৈর্ঘ্য দুই কিলোমিটার।
প্রতিটি ট্রেঞ্চ প্রায় ৩ মিটার গভীর, ২ মিটার প্রশস্ত। অনুমান করা হয়, সেখানে দশ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা ড্রোনচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, ধুমায়ের মাটিতে কুতাইফাহ এলাকার উপমাটির চিহ্ন মিশে গেছে—এটি প্রমাণ করে যে কুতাইফাহের মাটি, অর্থাৎ মৃতদেহসহ, ধুমায়ের মরুভূমিতে এনে পোঁতা হয়েছে।

স্থানীয় মেকানিক আহমেদ গাজাল, যিনি ট্রাকগুলোর মেরামতের কাজ করতেন, প্রথমবার বুঝতে পারেন ট্রাকের ভেতরে কী বহন করা হচ্ছে।
একবার ট্রাক মেরামতের সময় তার এক শিক্ষানবিশের ওপর পচা হাত পড়ে যায়। গাজাল বলেন, “আমি বুঝে গেলাম কী ঘটছে। কিন্তু কথা বললে আমাকেও হয়তো সেই ট্রেঞ্চে পুঁতে ফেলত।”

আজও সেই স্মৃতি তার ঘুম কেড়ে নেয়। তিনি রয়টার্সকে ধুমায়ের সেই জায়গাটি দেখান—যেখানে মাটির নিচে হাজারো অচেনা মানুষ চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে শেষ হয় “অপারেশন মুভ আর্থ”।
তারপর কুতাইফাহের পুরনো গণকবর মাটিচাপা দিয়ে সমান করে ফেলা হয়, যেন কোনোদিন তা ছিলই না।

রয়টার্সের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়—উভয় স্থানেই বুলডোজারের দাগ, ভিন্ন রঙের মাটি এবং ঢেকে দেওয়া খনিগর্ত।

একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেন, “আসাদ জানতেন, একদিন বিচার আসবে। তাই কোনো নথিতে নিজের নাম রাখতে চাননি।”

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও গণকবরগুলোর প্রকৃত তথ্য এখনো প্রকাশ পায়নি।
দেশটির নতুন ন্যাশনাল কমিশন ফর মিসিং পারসনস জানিয়েছে, এই বিশৃঙ্খল লাশ স্থানান্তরের ফলে নিহতদের শনাক্ত করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা একটি ডিএনএ ব্যাংক ও ডিজিটাল ডেটাবেইস তৈরির পরিকল্পনা করছে, কিন্তু দক্ষ জনবল ও অর্থের অভাবে কাজ এগোচ্ছে না।

ধুমায়ের সেই মরুভূমির দিকে তাকিয়ে আহমেদ গাজাল বলেন, “মানুষ এখনো তাদের হারানো সন্তানদের খুঁজছে কুতাইফাহতে। কিন্তু আসলে তারা সবাই এখানে—এই মরুভূমির নিচে।”

রয়টার্সের এই অনুসন্ধান কেবল এক দেশের যুদ্ধাপরাধ নয়, বরং প্রমাণ করে—ক্ষমতার ভয়ে সত্য কত গভীরে চাপা পড়ে যেতে পারে।
ধুমায়ের মরুভূমি আজ শুধু একটি গণকবর নয়, বরং এক জাতির দীর্ঘদিনের কান্নার প্রতীক—যেখানে বালুর নিচে এখনো শুয়ে আছে নির্মম নীরবতার হাজারো কণ্ঠস্বর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ