logo
ads

যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ মুছতে আসাদ সরকারের গোপন অভিযান

রয়টার্স

প্রকাশকাল: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১৬ পি.এম
যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ মুছতে আসাদ সরকারের গোপন অভিযান

সংগৃহীত ছবি

সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের সরকার ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গোপনে হাজার হাজার হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষের মরদেহ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়েছিল—এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।

সংস্থাটির অনুসন্ধান অনুযায়ী, দামেস্কের উপকণ্ঠে কুতাইফা এলাকায় অবস্থিত একটি বিশাল গণকবর থেকে মরদেহগুলো ট্রাকে করে মরুভূমির ধুমায়ির এলাকায় গোপনভাবে স্থানান্তর করা হয়। এই অভিযানের নাম ছিল “অপারেশন মুভ আর্থ”।

রয়টার্স জানায়, আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী প্রায় দুই বছর ধরে সপ্তাহে চার রাত কুতাইফা থেকে মরুভূমির ধুমায়ির এলাকায় মরদেহবাহী ট্রাক পাঠাত। প্রত্যেক রাতে ছয় থেকে আটটি ট্রাক মরদেহ ও মাটি ভর্তি অবস্থায় চলাচল করত।

অভিযানে যুক্ত ছিলেন সেনা কর্মকর্তা, ট্রাকচালক, মেকানিক ও বুলডোজার চালকরা। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, “কেউ প্রশ্ন করতে পারত না, না হলে নিজেকেই সেই গর্তে ফেলা হতো।”

২০১২ সাল থেকে কুতাইফা এলাকায় আসাদ সরকারের সেনারা বন্দিদের ও সৈন্যদের মরদেহ পুতে রাখত। ২০১৪ সালে একজন মানবাধিকারকর্মী গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশ করলে কবরস্থানের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে। পরে আন্তর্জাতিক মহলের নজর পড়ে সেখানে।

২০১৮ সালে যুদ্ধ জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে আসাদ সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ফেরানোর চেষ্টা করছিল। ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নেয় প্রমাণ গোপন করার—সেই সিদ্ধান্ত থেকেই জন্ম নেয় “অপারেশন মুভ আর্থ”।

রয়টার্সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ধুমায়িরের মরুভূমিতে নতুন এই গণকবরে রয়েছে অন্তত ৩৪টি খাল, প্রতিটির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই কিলোমিটার। উপাত্ত ও সাক্ষ্য বলছে, সেখানে দশ হাজারেরও বেশি মরদেহ পুঁতে রাখা হয়েছে। এই স্থানান্তরের ফলে আগের কুতাইফা কবরের ১৬টি খাল পুরোপুরি খালি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই অভিযান সিরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রমাণ লোপাটের ঘটনা। সিরিয়া জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি সেন্টারের পরিচালক মোহাম্মদ আল আব্দাল্লাহ বলেন, “এভাবে মরদেহ সরিয়ে নেওয়া মানে পরিবারগুলোর জন্য চিরস্থায়ী শোক তৈরি করা। এখন আর ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় মেলানো অত্যন্ত জটিল হয়ে গেছে।”

গত বছর ডিসেম্বর মাসে আসাদ সরকারের পতনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। সিরিয়ার জরুরি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী রায়েদ আল-সালেহ জানিয়েছেন, সরকার ইতোমধ্যে ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর মিসিং পিপল’ গঠন করেছে, যা নিখোঁজদের পরিচয় শনাক্তে কাজ করবে। 

তিনি বলেন, “যতদিন মা তার সন্তানের কবর খুঁজে না পায়, স্ত্রী স্বামীর কবর না জানে—সিরিয়ার ক্ষত ততদিন রক্তাক্ত থাকবে।”

কমিশনটি ডিএনএ ব্যাংক ও ডিজিটাল তথ্যভান্ডার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞের অভাব ও সীমিত অর্থনৈতিক সক্ষমতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, “আসাদ সরকারের এই গোপন অভিযান যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ।”

রয়টার্সের ড্রোনচিত্র, সাক্ষ্য ও নথিপত্র বিশ্লেষণ বলছে—আসাদ সরকারের এই “অপারেশন মুভ আর্থ” শুধু কবর স্থানান্তরের গল্প নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস মুছে ফেলার প্রচেষ্টা। কিন্তু মরুভূমির বালিতে চাপা পড়া সেই মৃতদের নিঃশব্দ আর্তনাদ এখনো শোনা যায়—সিরিয়ার প্রতিটি শোকার্ত পরিবারের বুকের ভেতর।

সূত্র: রয়টার্সের বিশেষ তদন্ত, সিরিয়ার বিচার ও জবাবদিহিতা কেন্দ্র; আল-ওয়াতান; ইউএনএইচআরসির বিবৃতি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ