logo
ads

ক্ষুধা, ভয় আর বন্দিদশার দেশ ইয়েমেনে হুথি শাসনের নির্মম বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশকাল: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০৮ পি.এম
ক্ষুধা, ভয় আর বন্দিদশার দেশ ইয়েমেনে হুথি শাসনের নির্মম বাস্তবতা

সংগৃহীত ছবি

ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর এডেনে এক শরণার্থী শিবিরের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ৩৭ বছর বয়সী কৃষক আবদুস সালাম বললেন, “হুথিরা আপনাকে দুইটি বিকল্প দেয়—তাদের সমর্থন করুন ও খাবার পান, অথবা ক্ষুধায় মরুন।” হাজার হাজার ইয়েমেনি আজ এমনই এক বাস্তবতার মুখোমুখি—যেখানে ক্ষুধা, ভয় ও নিপীড়নই জীবনের দৈনন্দিন অংশ।

ইরান সমর্থিত হুথি বাহিনী ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলসহ রাজধানী সানায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটিতে কার্যত একদলীয় শাসন চলছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থানের কারণে হুথিদের ‘প্রতিরোধের প্রতীক’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে তাদের দখলকৃত অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ভয়াবহ।

নিপীড়ন ও জোরপূর্বক আনুগত্য

শরণার্থী ও মানবাধিকারকর্মীদের বরাতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, হুথি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে ‘আমেরিকা ও ইসরায়েলের মৃত্যু হোক’ ধ্বনি দিতে, তাদের প্রোপাগান্ডা র‍্যালিতে অংশ নিতে এবং শিশুদের সৈনিক হিসেবে পাঠাতে। অন্যদিকে, যারা এই শর্ত মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে চলছে দমননীতি, আটক ও নির্যাতনের ঘটনা।

সানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবদুল মালিক জানান, তিনি স্কুলে হুথি আদর্শ প্রচারের ক্লাসে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানালে চাকরি হারান। “বেতন বন্ধ, ঘরে খাবার নেই, তবু প্রতি শুক্রবার আমাকে বাধ্য করত হুথিদের র‍্যালিতে অংশ নিতে,” বলেন তিনি।

মানবিক সহায়তার অপব্যবহার

২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ইয়েমেনের মানবিক ত্রাণে ২৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যার এক তৃতীয়াংশ গেছে হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খাদ্য সহায়তা হিসেবে। কিন্তু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এই সাহায্যের বড় অংশই হুথি নেতাদের হাতে চলে গেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০২৩ সালে এই অনিয়মের কারণে হুথি অঞ্চলে খাদ্য বিতরণ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।

এক ত্রাণকর্মী রয়টার্সকে বলেন, “যাদের নাম তালিকায় আছে তাদের অর্ধেকই অস্তিত্বহীন—তারা ভূতের মতো নাম।”

শিশুসেনা ও জোরপূর্বক ধর্মীয় ব্রেনওয়াশ

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৯ সাল থেকেই হুথিরা শিশুদের জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিচ্ছে। গাজা যুদ্ধের পর এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। একসময় হুথি দখল থেকে পালিয়ে আসা ১৮ বছর বয়সী আবদেল-মোগনি আল-সিনানি জানান, “আমাদের শেখানো হতো—প্রধান আবদুল মালিক আল-হুথির আশীর্বাদ পেলেই সরাসরি জান্নাতে যাওয়া যায়।”

ত্রাণকর্মী ও বিদেশিদের ওপর নিপীড়ন

শুধু সাধারণ নাগরিক নয়, জাতিসংঘ ও মার্কিন সহায়তা সংস্থার কর্মীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আগস্টে সানায় হুথি বাহিনী জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ১৫ জন কর্মীকে আটক করে, বর্তমানে ৫০ জনেরও বেশি ত্রাণকর্মী তাদের হাতে বন্দি।

হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে পালিয়ে আসা পরিবারগুলো আজ এডেন ও মারিবের শরণার্থী শিবিরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। অধিকাংশ পরিবার দিনে একবার খাবার পায়। একজন মা ফোলা আল-হাদি বলেন, “আমরা প্রতিদিন রেস্তোরাঁর বর্জ্য খুঁজে ফিরি। কিন্তু অন্তত এখন আমার ছেলেদের আর বন্দুক হাতে যেতে হয় না।”

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “হুথিদের মানবিক সহায়তা বিতরণে বাধা সৃষ্টি ও বেসামরিকদের ওপর নির্যাতন ইয়েমেনের ক্ষুধা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।” অন্যদিকে, হুথি মুখপাত্র নাসরুদ্দিন আমের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “এটি মার্কিন–ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা; আমরা কোরআনের আদর্শে চলি।”

বিশ্বজুড়ে ‘প্রতিরোধের শক্তি’ হিসেবে হুথিদের প্রশংসা পেলেও ইয়েমেনের ভেতরে তাদের শাসন জনগণের জন্য নতুন এক নরক। ক্ষুধা, ভয়, বন্দিদশা ও মানবিক সহায়তার রাজনৈতিক অপব্যবহার—সব মিলিয়ে আজ ইয়েমেন এক নিঃশব্দ মানবিক বিপর্যয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

সূত্র: রয়টার্স, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP), আল জাজিরা, বিবিসি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ