বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, আর সেই উত্থানে সবচেয়ে বেশি লাভবান দেশগুলোর একটি এখন ইতালি। ইউরোপীয় ঋণ সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও দেশটি তার বিপুল স্বর্ণের মজুদ কখনো বিক্রি করেনি—আর এখন সেই সতর্ক অবস্থানই তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Bank of Italy) বর্তমানে ২,৪৫২ মেট্রিক টন স্বর্ণ ধারণ করে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—দেশটির ২০২৪ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১৩ শতাংশ। এই মজুদের পরিমাণে ইতালি এখন যুক্তরাষ্ট্র (৮,১৩৪ টন) ও জার্মানির (৩,৩৫৪ টন) পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্বর্ণের মালিক দেশ।
ইতালির স্বর্ণের প্রতি ভালোবাসা শুধু আধুনিক অর্থনীতির অংশ নয়, বরং তা রোমান সাম্রাজ্যের যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। জুলিয়াস সিজারের সময়ের “অরিয়াস” স্বর্ণমুদ্রা ছিল সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী এবং ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার মিলে ১২০ টন স্বর্ণ লুণ্ঠন করেছিল। যুদ্ধ শেষে দেশটির হাতে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২০ টন। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী "অর্থনৈতিক বিস্ময়" সময়ে (১৯৫০–৬০-এর দশক) ইতালি পুনরুদ্ধার করে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ স্বর্ণে এবং ১৯৬০ সালের মধ্যে মজুদ দাঁড়ায় ১,৪০০ টনে।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দাসহ একাধিক অর্থনৈতিক সংকটেও ইতালি স্বর্ণ বিক্রি করেনি। ব্যাংক অব ইতালির সাবেক উপ-গভর্নর সালভাতোরে রসি তার বই “Oro (Gold)”-এ লিখেছেন, “স্বর্ণ হচ্ছে পরিবারের রূপার বাসনের মতো—শেষ সময়ের ভরসা। কোনো দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা নড়বড়ে হলে এটিই টিকে থাকার প্রতীক।” ১৯৭০-এর দশকে তেলের ধাক্কা সামলাতে ইতালি তার স্বর্ণ বন্ধক রেখে জার্মানির কাছ থেকে ঋণ নেয়, কিন্তু বিক্রির পথে কখনো যায়নি।
ইতালির প্রায় ১,১০০ টন স্বর্ণ সংরক্ষিত আছে রাজধানী রোমের Palazzo Koch ভবনের নিচে অবস্থিত গোপন ভল্টে। অন্য অংশের স্বর্ণ রাখা আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডে। তাছাড়া ব্যাংক অব ইতালির তথ্যমতে, তাদের কাছে প্রায় ৮৭১,৭১৩টি স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে, যার ওজন প্রায় ৪.১ টন।
ইতালির জাতীয় ঋণ বর্তমানে ৩ ট্রিলিয়ন ইউরোর বেশি, যা দেশটির মোট জিডিপির ১৩৭ শতাংশেরও বেশি। অনেকে দাবি করছেন, এই বিপুল স্বর্ণের মজুদ বিক্রি করলে সরকার কিছুটা আর্থিক স্বস্তি পেতে পারে। তবে অর্থনীতিবিদ জিয়াকোমো কিওরিনো বলেন, “স্বর্ণের অর্ধেক বিক্রি করলেও ইতালির ঋণ সমস্যার সামান্যই সমাধান হবে।” অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ স্টেফানো কাসেল্লি মনে করেন, বর্তমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও ডিজিটাল মুদ্রার উত্থানের যুগে স্বর্ণ এখনও সবচেয়ে নিরাপদ সম্পদ। “ব্যাংক অব ইতালির অতীত সিদ্ধান্ত এখন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে তারা সেই ঐতিহাসিক অবস্থান থেকেই আবারও লাভবান।”
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের শেষে ইতালির সরকারি রিজার্ভের ৭৫ শতাংশই স্বর্ণ, যেখানে ইউরোজোনের গড় মাত্র ৬৬.৫ শতাংশ।
এছাড়া ইতালি এখনও বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বর্ণ অলংকার রপ্তানিকারক দেশ, যেখানে আলেসান্দ্রিয়া, আরেজো ও ভিচেঞ্জা শহরগুলোকে বলা হয় ইউরোপের “গোল্ড ট্রায়াঙ্গল”।
ইতালির এই ‘স্বর্ণ নীতি’ শুধু আর্থিক নয়, বরং জাতীয় আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বাজারে স্বর্ণের দাম যতই বাড়ুক না কেন, রোম কখনো তার “শেষ অবলম্বন” বিক্রি করবে না—এমনটাই বলছে দেশের ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।
সূত্র: রয়টার্স , ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল, ফিনান্সিয়াল টাইমস, ব্লুমবার্গ, ব্যাংক অফ ইতালি আর্কাইভস

