ময়মনসিংহের নান্দাইলের চারআনিপাড়া মহল্লায় যেন এক কালো মেঘ নেমে এসেছে—সংসারে সচ্ছলতার আলো জ্বালাতে সৌদি আরবে পা রাখা মো. মোস্তুফা মিয়া (৩৫) সাত মাসের মাথায় ফিরেছেন লাশ হয়ে, যেন ভাগ্যের নির্মম হাতে ছিন্ন হয়ে গেছে এক পরিবারের সব স্বপ্ন। বুধবার (৮ অক্টোবর) ভোরে ঢাকায় তার মরদেহ পৌঁছানোর পর দুপুরে অ্যাম্বুলেন্সে গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়, আর সেই মুহূর্তে যেন এলাকায় শোকের এক অবিরাম ঢেউ বইতে থাকে—প্রতিবেশীদের চোখে অশ্রু, পরিবারের হৃদয়ে অন্ধকার, যেন মোস্তুফার অকাল মৃত্যু শুধু একটি জীবনের শেষ নয়, বরং হাজারো পরিবারের প্রবাসী স্বপ্নের এক মর্মান্তিক প্রতিচ্ছবি।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মৃত আব্দুশ ছাত্তারের ছেলে মোস্তুফা মিয়া চলতি বছরের ৩ এপ্রিল ধারদেনা করে ৬ লাখ টাকা খরচে সৌদিতে যান, সেই স্বপ্ন নিয়ে যেন সংসারের অন্ধকার দূর করবেন—কিন্তু আদম ব্যবসায়ীর প্রতিশ্রুতি মিথ্যা হয়ে যায়, কাজ না পেয়ে পরিচিতদের আশ্রয় নেন, পুলিশের ভয়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থাকেন। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে গুরুতর অসুস্থ হন, কয়েকজন বাংলাদেশি তাকে উদ্ধার করে কিংস ফাহাদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন—কিন্তু চিকিৎসার মধ্যেও তার হৃদয় থেমে যায়। এদিকে স্ত্রী নাছিমা বেগম এক দালালের ফাঁদে পড়ে আড়াই লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, কোনো কাজ হয় না; লাশ ফিরিয়ে আনতে দালালের দ্বারস্থ হলেও ফল হয় না, আবার ধার করে ৪ লাখ টাকা পাঠাতে হয়—যেন মৃত্যুর ওপর খাঁড়ার ঘা, এক ছেলে-এক মেয়ের মা নাছিমার হৃদয়ে জাগছে সেই অসীম অসহায়তা যেন কীভাবে চলবে এই ভাঙা সংসার।
নাছিমার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে স্মৃতি তুলে: “ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগের জসিম উদ্দিনের ছেলে লাল মিয়া ও কসম আলীর ছেলে এখলাস উদ্দিনের ফাঁদে ৬ লাখ টাকা দিয়ে পাঠাই, কথা ছিল সৌর বিদ্যুতের কাজে ৪০ হাজার টাকা বেতন—কিন্তু কাজ হয়নি, যোগাযোগও ছিন্ন। অসুস্থ হলে আড়াই লাখ পাঠাই বাঁচাতে, কিন্তু সব শেষ। ধারের ঋণ পরিশোধের স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিল স্বামী, এখন আমরা বেঁচে থেকেও মৃত—এক ছেলে-এক মেয়ে নিয়ে কীভাবে টিকবো?” তার চোখে ঝরছে অশ্রু, যেন প্রতিটি ফোঁটা একটি ভাঙা স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে, প্রতিবেশীরা যেন এক পরিবারের মতো কাঁদছে, কারণ মোস্তুফার মতো হাজারো যুবক প্রবাসে স্বপ্ন নিয়ে যান, কিন্তু অনেকেই ফিরে আসেন লাশ হয়ে—দালালের ফাঁদ, অসুস্থতা ও অর্থনৈতিক চাপের এই ত্রয়ী যেন বাংলাদেশের প্রবাসী সমাজের এক অবিরাম যন্ত্রণা।
মোস্তুফার মৃত্যু যেন শুধু এক পরিবারের নয়, বরং সমগ্র দেশের এক জাগরণের ডাক—দালালপ্রথা, প্রবাসী নিরাপত্তাহীনতা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব যেন হাজারো পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। নাছিমার এই অসহায় কান্না আমাদের সকলের হৃদয়ে জাগিয়েছে সেই তীব্র অনুভূতি যেন প্রবাসী কল্যাণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক, দালালদের শাস্তি হোক, এবং কোনো স্বপ্ন আর এমনভাবে ভেঙে না পড়ে—মোস্তুফার স্মৃতি যেন এক মশালের মতো জ্বলতে থাকুক, যা অন্য যুবকদের পথ দেখাবে নিরাপদ প্রবাসের দিকে, গর্বিত এবং অটুট।

