দেশের বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে দেখা দিয়েছে তীব্র মন্দা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন। তিন মাস আগে জুন শেষে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর গত জুলাইয়ে তা ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকারের পরিবর্তনের পর বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, এবং ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার—এই তিনটি কারণ মিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমছে। ছাত্র–জনতা অভ্যুত্থানের পর ব্যবসায়ীরা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকছেন। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন সীমিত করেছে, কেউ কেউ পুরোপুরি বন্ধও করে দিয়েছে।
ফলে কর্মসংস্থানেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, দ্রুত বাড়ছে বেকারত্ব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “বর্তমানে প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ রেখেছে। আবার অনেক ব্যাংক সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকছে, কারণ তা তুলনামূলক নিরাপদ।”
বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) বাড়িয়েছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার বেড়ে ১৪–১৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন,
“বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন আস্থা। রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা না কাটলে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নেবেন না। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই অনিশ্চয়তা থেকে যাবে।”
ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ঋণ কার্যক্রম স্থগিত বা সীমিত করা হয়েছে।
বর্তমানে অন্তত পাঁচটি ব্যাংক গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতেও সমস্যায় পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১ হাজার ৩০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়মিত করার আবেদন করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৩০০টি প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থায় পুনর্গঠিত ঋণ পেয়েছে—তাদের অনেকেরই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও বেসরকারি খাত পুনরুদ্ধারে এখনও গতি ফেরেনি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে ও সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে এলে বিনিয়োগচক্রে প্রাণ ফিরে আসবে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর (পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট) বলেন,
“বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার উদ্বেগজনক। এটি শুধু বিনিয়োগ নয়, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে ব্যাংক খাতে আস্থা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।”

