তিস্তার জল যেন এক অদম্য ক্রোধে ফুঁসছে—এর তীরে বছরের পর বছর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গ্রাম-গঞ্জ, বাড়ি-ঘর, আর হাজারো মানুষের স্বপ্ন। রংপুরের উত্তাঞ্চলে, যেখানে নদীর স্রোতের সাথে মিশে যায় কৃষকের ঘাম আর মায়ের অশ্রু, সেখানে বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর, ২০২৫) সন্ধ্যার অন্ধকার ছিন্ন করে জ্বলে উঠল হাজারো মশালের আলো। লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ১১টি পয়েন্টে একযোগে এই মশাল প্রজ্বলন—যেন এক অগ্নিশিখা, যা তিস্তা মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের দাবিতে ১০০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। ছবির এই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্র: মশালের লেলিহান আলোয় ভরা প্রাঙ্গণ, মুখোশ-মাথায় বাঁধা মানুষের ভিড়, আর পিছনে দূরের আকাশে ছড়ানো আলোর বিন্দু—যা শুধু প্রতিবাদ নয়, এক পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াই। এই কর্মসূচির উদ্বোধন করলেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী, সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক আসাদুল হাবিব দুলু—তাঁর হাতে প্রথম মশাল জ্বলে উঠল, যেন তিস্তার ক্ষতচিহ্নে স্পর্শ করল এক নতুন আশার স্ফুলিঙ্গ।
প্রতিবাদের এই আলোয় মিশে গেল দুলুর কণ্ঠস্বর, যা যেন তিস্তার স্রোতের মতো গভীর ও অটল। বক্তৃতায় তিনি বললেন, “তিস্তাপাড়ার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য আমরা একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছি। কখনো শোভাযাত্রা, কখনো অবস্থান, কখনো গণমিছিল বা স্মারকলিপি—সবই করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত আমাদের এই কান্নাকে সরকার আমলে নেয়নি। তিস্তা শুধু লালমনিরহাটের সমস্যা নয়, এটি দেশের জাতীয় সমস্যা।” তাঁর চোখে জ্বলজ্বলে অশ্রু, কণ্ঠে মিশে গেল এক মায়ের কান্না—কারণ, রংপুর বিভাগের নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ১৩০ কিলোমিটার এলাকায় তিস্তা যেন এক অদম্য শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। “একসময় মায়ের মতো আপন ছিল এই তিস্তা, আজ সে-ই আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,”—দুলুর এই কথায় ভিড়ের মধ্যে উঠল এক দীর্ঘশ্বাস, যেন নদীর গভীরতায় ডুবে গেল সবার বেদনা। ভারতের উজানী থেকে জল ছাড়ার অভাবে শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যায়, বর্ষায় হঠাৎ বন্যায় গ্রাস করে সবকিছু—কৃষকের ফসল, মানুষের ঘরবাড়ি, আর শিশুদের স্বপ্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই নদীতে বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে, আর কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে।
সরকারের প্রতি দুলুর সমালোচনা যেন এক তীক্ষ্ণ তীর, যা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। “আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছি, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে শুধু আশ্বাসই মিলছে।” তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, চীনের সহায়তায় তিস্তা মেগা প্রকল্পের কথা—যা বাঁধ নির্মাণ, খনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সংরক্ষণের মাধ্যমে এই এলাকাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু ভারতের বিরোধিতা আর সরকারের বিলম্বে এই প্রকল্প এখনও কাগজে আটকে আছে। দুলু হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, “আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করতে হবে। অন্যথায় বৃহত্তর রংপুরে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল করে দেওয়া হবে।” এই কথায় ভিড়ের মধ্যে উঠল করতালির ধ্বনি, যেন মশালের আলোয় জ্বলে উঠল এক অটল সংকল্প। তিনি আরও বললেন, “সরকার ধীরগতিতে কাজ করছে, আবার কেউ কেউ তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যারা এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে, তারা দেশ ও জাতির শত্রু।” এই প্রতিবাদ যেন এক মায়ের কোলে শিশুর কান্না—যা শুধু দাবি নয়, বেঁচে থাকার অধিকার।
ছবির এই মশালের ভিড় যেন এক জীবন্ত সাক্ষ্য: সামনে মশাল হাতে দাঁড়ানো যুবক-যুবতী, পিছনে দূরের আকাশে ছড়ানো আলোর মালা—যা তিস্তার দুই তীরের মানুষের একতাকে ফুটিয়ে তোলে। এই আন্দোলন শুধু স্থানীয় নয়, এটি এক জাতীয় দাবি—যেখানে চীনের ৬৫০০ কোটি টাকার ঋণের প্রস্তাব সত্ত্বেও ভারতের বিরোধিতায় প্রকল্প আটকে আছে। পরিবেশ ও জলসম্পদ উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের সাম্প্রতিক ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বর ২০২৫-এ শুরু হবে, কিন্তু এই মশাল প্রজ্বলন যেন সেই প্রতিশ্রুতিকে মনে করিয়ে দেয়: আর অপেক্ষা নয়, এখনই সময়। তিস্তার এই কান্না যেন একদিন ফুলে উঠবে জয়ের হাসিতে—যদি সরকার শোনে এই মশালের আওয়াজ।

