যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের সম্মানে গতকাল রাতে উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হলে এক জমকালো রাজকীয় ভোজের আয়োজন করেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা। এই ভোজে কূটনীতি, সংস্কৃতি, এবং ব্রিটিশ খাদ্য ঐতিহ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে, যা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বকে আরও জোরালো করেছে।
ঝকঝকে হলঘরে ১৬০ জন গণ্যমান্য অতিথির জন্য ৪৭ মিটার লম্বা টেবিল সাজানো হয়েছিল ১,৪৫২ পিস রুপালি ছুরি-চামচ-তৈজস আর প্রতিটি অতিথির সামনে পাঁচ রকমের কাচের গ্লাস দিয়ে। ফরাসি ভাষায় লেখা মেনুতে ছিল ব্রিটিশ স্থানীয় উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি সুস্বাদু খাবার। অতিথিরা উপভোগ করেন হ্যাম্পশায়ারের ওয়াটারক্রেস পানা কোটা, কোয়েল পাখির ডিমের সালাদ ও পারমেজান শর্টব্রেড দিয়ে তৈরি স্টার্টার। প্রধান পদ ছিল জুচিনি দিয়ে মোড়ানো অর্গানিক নরফোক চিকেন ব্যালোটিন, থাইম ও সেভরি মসলার সসের সঙ্গে। ডেজার্টে পরিবেশন করা হয় কেন্টের রাস্পবেরি সরবেতসহ ভ্যানিলা আইসক্রিম, যার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় পোচ করা ভিক্টোরিয়া প্লাম। পানীয়ের মধ্যে ছিল কয়েক পদের ওয়াইন এবং বিশেষ আকর্ষণ—ট্রান্স-আটলান্টিক হুইস্কি সাওয়ার ককটেল, যা জনি ওয়াকার হুইস্কি, কমলার জেলি, পেকান ফোম ও টোস্ট করা মার্শমেলোর অনন্য মিশ্রণে তৈরি। ট্রাম্প, যিনি অ্যালকোহল গ্রহণ করেন না, নন-অ্যালকোহলিক ভার্সন উপভোগ করেন বলে জানা গেছে।
এই ভোজে অতিথি ছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়াম, প্রিন্সেস অব ওয়েলস কেট মিডলটন, প্রিন্সেস অ্যান, ট্রাম্পের কন্যা টিফানি, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, অ্যাপলের সিইও টিম কুক, ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান, এবং মিডিয়া মোগল রুপার্ট মার্ডকের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে হলিউডের বড় তারকাদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল, যা এই ভোজের কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করে।
ব্রিটিশ রাজকীয় খাদ্য ঐতিহ্য: অতীত থেকে বর্তমান
ব্রিটিশ রাজকীয় ভোজের ঐতিহ্য মধ্যযুগ থেকে শুরু। টিউডর রাজা হেনরি অষ্টমের সময়ে ময়ূর, হরিণ মাংস, এবং ৬,০০০ অ্যাসপারাগাস স্টকের মতো বিলাসবহুল খাবার পরিবেশন করা হতো। স্টুয়ার্ট যুগে চার্লস দ্বিতীয়ের ভোজে ২,১৫০ পদের পোলট্রি ও প্রথমবারের মতো আইসক্রিম দেখা যায়। ভিক্টোরিয়ান যুগে রোস্ট বিফ, ফাইলেট অফ সোল, এবং ক্রিসমাস পুডিং জনপ্রিয় হয়। কুইন এলিজাবেথ দ্বিতীয়ের সময়ে স্যান্ড্রিংহামের ফেনাসান্ট ও ট্রাফলসের মতো পদ ছিল হাইলাইট। আধুনিক যুগে রাজা তৃতীয় চার্লস টেকসই ও অর্গানিক উপাদানের উপর জোর দিয়েছেন, যা ট্রাম্পের ভোজে নরফোক চিকেন ও কেন্টের রাস্পবেরির ব্যবহারে ফুটে উঠেছে।
এই ভোজে ফরাসি রন্ধনশৈলীর প্রভাব স্পষ্ট—নরম্যান বিজয়ের পর থেকে ফরাসি ভাষায় মেনু লেখার ঐতিহ্য চলে আসছে। ঔপনিবেশিক যুগের মশলা ও উপাদান, যেমন ভারতীয় মশলা বা ক্যারিবীয় ফল, রাজকীয় রান্নাকে বৈচিত্র্যময় করেছে। ট্রান্স-আটলান্টিক ককটেলটি এই বৈচিত্র্যের প্রতীক, যেখানে স্কটিশ হুইস্কি ও আমেরিকান পেকান ফোম মিলে দুই দেশের সংস্কৃতির সেতু তৈরি করেছে।
রাজকীয় আড়ম্বর ও কূটনীতি
ট্রাম্পের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফরে এই ভোজ ছিল কূটনৈতিক তাৎপর্যে ভরপুর। মঙ্গলবার রাতে এয়ারফোর্স ওয়ান স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দরে অবতরণ করলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়ারেন স্টিফেনস তাঁদের স্বাগত জানান। বুধবার উইন্ডসরে লাল গালিচা, ৪১ বার তোপধ্বনি, এবং ১,৩০০ সৈন্য ও ১২০ ঘোড়ার অশ্বারোহী প্রদর্শনী ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম সংবর্ধনা। ভোজের সময় ট্রাম্প বলেন, “এটি আমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান!” ফুলের সজ্জা বাকিংহাম প্যালেসের গার্ডেন থেকে আনা হয়, যা পরে রানি ক্যামিলার চ্যারিটি ‘ফ্লোরাল অ্যাঞ্জেলস’-এ দান করা হয়।
অতীতের ছোঁয়া, আধুনিক স্বাদ
এই ভোজে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণ লক্ষণীয়। যেখানে মধ্যযুগে ময়ূরের মতো বিরল খাবার ক্ষমতার প্রতীক ছিল, সেখানে আজ রাজা চার্লসের ভোজে পরিবেশবান্ধব অর্গানিক উপাদান ব্যবহার টেকসই ভবিষ্যতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ। ট্রাম্প ও মেলানিয়া এই স্বাদের অভিজ্ঞতাকে “অসাধারণ” বলে প্রশংসা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভোজ নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে, কেউ এটিকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলছেন, কেউ বা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে সবাই একমত যে, এই রাজকীয় ভোজ ব্রিটিশ আতিথেয়তার এক অতুলনীয় প্রদর্শনী।
সংবাদদাতার মন্তব্য: এই ভোজ কেবল খাবারের আয়োজন নয়, বরং শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক কূটনীতির এক জীবন্ত চিত্র। রাজকীয় স্বাদের এই রাত্রি দুই দেশের বন্ধনকে আরও মধুর করেছে।

