শুক্রবারের সেই রাতে লালমনিরহাটের আকাশ যেন লালনের গানের সুরে ভিজে উঠল। সোনালী পার্কের মীর লাইব্রেরি মিলনায়তনে রাত ৮টার দিকে এক অপূর্ব মিলনময় অনুষ্ঠানের সূচনা হয়—যেখানে বাউলের মাদকতাময় সুর, বৈষ্ণব পদাবলীর মধুর ভক্তি, সুফির গভীর প্রেমের আকাঙ্ক্ষা এবং মরমি সংগীতের মানবিক আহ্বান একসঙ্গে মিলে এক অমর স্রোত গড়ে তুলল। সাংস্কৃতিক সংগঠন 'মন্দিরা' ও 'মনদুয়ার'-এর উদ্যোগে এই আয়োজন হয়েছে লালন সহ ভাবসংগীতের নানাধারা নিয়ে মুক্ত আলোচনা, স্মারক সম্মাননা এবং হৃদয়স্পর্শী সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে। এটি ছিল কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং আত্মার গভীরে লালনের দর্শনের আলো জ্বালানোর এক অভিযান—যা হাজারো বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আজকের যুবকদের হাতে তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি বহন করে।
অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শিল্পী ও চিন্তক অরূপ রাহী, যাঁর কথাগুলো যেন লালনের পদের মতোই হৃদয় ছুঁয়ে গেল। সভাপতিত্ব করলেন শামীম আহম্মেদ, যাঁর নির্লিপ্ত নেতৃত্বে আলোচনা পর্ব সমন্বয় করলেন দীপক রায়। আর সাংস্কৃতিক পর্বের মায়াময়তা ছড়ালেন প্রদীপ রায় ও শাহানূর ইসলামের দক্ষতায়। অরূপ রাহী বলে উঠলেন, "বাউল, বৈষ্ণব পদাবলী, সুফি গান ও মরমি সংগীত—এসবের মধ্যে শুধু সুর নয়, আধ্যাত্মিকতার অমৃতধারা বয়ে চলে। সুফি দর্শনে আল্লাহর সঙ্গে প্রেমের মিলনের আকাঙ্ক্ষা যেমন হৃদয়কে নাড়া দেয়, তেমনি লালনের গানে মানুষের মুখোমুখি হয়ে পরম সত্যকে খোঁজার আহ্বান শোনা যায়। এই গানগুলো প্রেমের সেতু, ভক্তির আলো এবং মানবতাবাদের অটুট বন্ধন।" তাঁর কথায় যেন সভাকক্ষের প্রতিটি হৃদয়ে একটি অদৃশ্য তার জ্বলে উঠল—বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই মর্মবাণী পৌঁছানোর জন্য যে তীব্র আহ্বান তুলে ধরলেন, তা ছিল এক অশ্রুসিক্ত আকুতি, যেন লালন নিজেই ফিরে এসে বলছেন, "মানুষ খুঁজে নে মানুষকে, সত্যের দরজা খোলা রয়েছে।"
আলোচনার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লালনের দর্শন যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। লালনের মানবতাবাদী চেতনা—যা জাত-ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে সকলের মধ্যে মানুষের সারাংশ খোঁজে—সেই চেতনা স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠে মিলে এক অপার্থিব সুরের স্রোত হয়ে বয়ে গেল। একে একে উঠে এলেন স্থানীয় কণ্ঠশিল্পীরা, যাঁদের গানে লালনের পদাবলী যেন আবার নতুন করে ফুটে উঠল। স্মারক সম্মাননায় যাঁরা পুরস্কৃত হলেন, তাঁদের চোখে দেখা গেল সেই গভীর আনন্দের ঝলক, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারকদের মনে এক অমূল্য সম্মানের অনুভূতি জাগায়।
এই অনুষ্ঠান শেষ হয়নি কেবল সুরের ঘোরে; এটি ছিল একটি বীজ, যা লালমনিরহাটের মাটিতে রোপিত হয়েছে—ভাবসংগীতের নানাধারা দিয়ে যুবকদের হৃদয়ে মানবতার আলো জ্বালানোর। লালনের সেই অমর বাণী আজও বলে, "সব লোকে কইলে কি হইবো, আমি তো মানুষ হবো।" এই রাতের মতোই, আমরা সকলে মানুষ হয়ে উঠি—প্রেমে, ভক্তিতে, আধ্যাত্মিকতায় মিলিত হয়ে।

