সূর্যাস্তের আলোয় যখন পানছড়ির ধানখেতগুলো সোনালি হয়ে ওঠে, তখন তারাবন ছড়ার এক কোনায় একটি ছোট্ট ঘর দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘরটি শুধু ইট-সিমেন্টের স্তূপ নয়; এটি একজন অসহায় যুবকের জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রতীক। কৃষ্ণ ত্রিপুরা, যার নামটাই যেন তার জীবনের কালো মেঘের সাথে মিলে যায়—কৃষ্ণ, অর্থাৎ কালো, কিন্তু আজ তার চোখে সেই কালোর মাঝে এক টুকরো আলো জ্বলছে। এই আলো জ্বালিয়েছে পানছড়ি উপজেলা যুবদল, যারা রাজনীতির খেলাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের হৃদয়ের দরজায় টোকা দিয়েছে।
কৃষ্ণের জীবন যেন এক অসমাপ্ত দুঃখের গল্প। বহু বছর আগে, যখন সে এখনও এক কিশোর ছিল, পিতামাতার হাত ছিন্ন হয়ে যায়। একাকী, নিঃস্ব, এতিম—এই শব্দগুলো তার জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। পানছড়ির এই ছোট্ট উপজেলায়, যেখানে জীবন ধানের সবুজে মোড়া, কৃষ্ণের দিনগুলো কৃষি শ্রমের কঠোরতায় কাটে। ভোরবেলা খেতে নামা, সূর্যের তাপে পিঠ পুড়িয়ে ফসল কাটা, আর সন্ধ্যায় ফিরে এসে খোঁজা একটা ছায়া—যেখানে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমানো যায়। কিন্তু সেই ছায়াও ছিল না তার। একটা স্থায়ী ঘরের অভাবে সে রাতের পর রাত আকাশের নিচে কাটিয়েছে, বৃষ্টির দিনে প্লাস্টিকের চাদরে আড়াল নিয়ে। সমাজের চোখে সে ছিল অদৃশ্য—একজন যার নেই কোনো ঠিকানা, নেই কোনো ভবিষ্যত। এমনকি বিয়ের কথা উঠলেই মেয়েরা দূরে সরে যেত; কে চায় একটা ঘরহীন, অসহায় ছেলের সাথে জীবন শুরু করতে?
কিন্তু জীবনের এই কালো অন্ধকারে একদিন হঠাৎ আলোর রশ্মি পড়ে। জননেতা ওয়াদুদ ভুইয়া, যিনি পানছড়ির মানুষের কাছে এক মানবিক দায়িত্বের প্রতীক, তাঁর নির্দেশে উপজেলা যুবদল সচল হয়। "যুবদল শুধু রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এটি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটি পরিবার,"—এই কথা বলে সদস্য সচিব মোঃ সেলিম যেন সংগঠনের মন্ত্রটি পুনরাবৃত্তি করেন। তারাবন ছড়ায় কৃষ্ণের খবর পৌঁছে যায় যুবদলের কানে। তারা শুধু শোনে না, কাজ করে। সংগঠনের নেতাকর্মীরা—আহ্বায়ক মোঃ আবছার, সদস্য সচিব মোহাম্মদ সেলিমসহ সবাই—মিলে একটা পরিকল্পনা গড়ে তোলে। লতিবান ইউনিয়নের এই ছড়ায় একটা ছোট্ট ঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ইটের স্তূপ, সিমেন্টের পাতলা, লোহার রড—সবকিছু যুবদলের হাতে নিয়ে তারা কয়েকদিনের মধ্যেই একটা আশ্রয় গড়ে তোলে। শুধু ঘর নয়, জীবিকা নির্বাহের জন্য আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়—একটা ছোট্ট বীজ, যা তার জীবনকে আবার ফুটিয়ে তুলবে।
সেই সহায়তা কার্যক্রমের দিনটি যেন তারাবন ছড়ার জন্য এক উৎসব। যুবদলের নেতারা কৃষ্ণের পাশে দাঁড়িয়ে, হাত মিলিয়ে দেন নতুন ঘরের চাবি। কৃষ্ণের চোখে জল—কিন্তু এবার সুখের জল। "আমি ভেবেছিলাম, জীবন এভাবেই কাটবে। কিন্তু আজ... আজ আমার একটা ঠিকানা আছে,"—তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে, কিন্তু মুখে হাসি ফুটে উঠছে। মোঃ সেলিম বলেন, "আমরা শুধু ঘর দিলাম না, আমরা আশা দিলাম। সমাজের এই অবহেলিত মানুষদের পাশে আমরা সবসময় থাকব। ভবিষ্যতে আরও এমন কাজ হবে, কারণ যুবদলের মানে মানুষের জন্য লড়াই।"
এই ঘটনা শুধু কৃষ্ণের জীবন বদলে দেয়নি; এটি পানছড়ির সমাজে একটা নতুন বার্তা ছড়িয়েছে। যে সমাজে অসহায়রা প্রায়ই ভুলে যায়, সেখানে যুবদলের এই হাত বাড়ানো যেন একটা চ্যালেঞ্জ—যে রাজনীতি শুধু ভোটের খেলা নয়, এটি মানুষের হৃদয় জয় করার খেলা। কৃষ্ণ আজ তার নতুন ঘরে বসে ভাবছেন, হয়তো এবার জীবনের সেই অপেক্ষিত অংশটা শুরু হবে—একটা পরিবার, একটা স্থায়ী জীবিকা। তার চোখে সেই কৃতজ্ঞতা শুধু যুবদলের প্রতি নয়, বরং পুরো মানবতার প্রতি।
পানছড়ির এই ছোট্ট গল্প যেন আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেয়: একটা হাত বাড়ালে কতটা আলো ছড়ানো যায়। যুবদলের এই উদ্যোগ যদি অন্যান্য সংগঠনের অনুকরণীয় হয়, তাহলে আমাদের দেশের প্রতিটি গ্রামে এমন আশার ঘর গড়ে উঠবে। কৃষ্ণ ত্রিপুরার গল্প শেষ হয়নি; এটি শুরু হয়েছে।

