বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবন এখনো প্রকৃতিনির্ভর। আধুনিক প্রযুক্তি বা শিল্পায়নের সুবিধা তাদের জীবনে পৌঁছায়নি বললেই চলে। ফলে খাবারের জন্য প্রতিদিন তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। পাহাড় কেটে জুম চাষ, বনে খাদ্য সংগ্রহ, নদী থেকে মাছ ধরা কিংবা দিনমজুরি—সবকিছুতেই এদের জীবন ভরপুর সংগ্রামে।
গবেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই জীবনধারা শুধু তাদের টিকে থাকার কাহিনি নয়, বরং প্রাচীন কৃষি ও সংগ্রাহক সভ্যতার জীবন্ত সাক্ষী।
নিচে বাংলাদেশের কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হলো—
১. ম্রো (Mro) – বান্দরবান
ম্রো জনগোষ্ঠী মূলত জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পাহাড় কেটে জমি তৈরি করা, ফসল ফলানো, ঝরনা থেকে পানি আনা—প্রতিটি ধাপেই প্রচুর কষ্ট পোহাতে হয়। বন থেকে শাকপাতা ও ফল সংগ্রহও তাদের খাদ্যের বড় অংশ।
২. চাক (Chak) – খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান
চাক জনগোষ্ঠী অল্প জমিতে ধান, ভুট্টা ও সবজি চাষ করে বেঁচে থাকে। পর্যাপ্ত জমি না থাকায় তাদের অনেকে বনের ফল, বাঁশকুঁড়ি, শাকপাতা খুঁজে আনতে বাধ্য হয়।
৩. খিয়াং (Khiyang) – পার্বত্য চট্টগ্রাম
খিয়াংরা জুম চাষ ও শিকার করে খাবার সংগ্রহ করে। পাহাড়ি এলাকার দুর্গম পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে বাজারে যেতে হয়, যা তাদের জীবনের নিয়মিত কষ্ট।
৪. পাংখোয়া (Pangkhua) – বান্দরবান
অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক পাংখোয়া পরিবার এখনো পাহাড়ে জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। খাবারের জন্য প্রতিদিন বন-জঙ্গল ঘুরে কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করতে হয়।
৫. চাকমা (Chakma) – রাঙামাটি ও বান্দরবান
চাকমারা ধান চাষে অভ্যস্ত হলেও জমির অভাবে অনেক পরিবার এখনো পাহাড় কেটে ফসল ফলায়। বনের বাঁশ ও শাকসবজিও তাদের খাবারের অংশ।
৬. মারমা (Marma) – পার্বত্য চট্টগ্রাম
মারমারা একদিকে ধান চাষ করে, অন্যদিকে নদী থেকে মাছ ধরে। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলে ফসল নষ্ট হলে তাদের খাবারের সংকট দেখা দেয়।
৭. সাঁওতাল (Santal) – রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর
সাঁওতালরা কৃষিশ্রমিক হিসেবেই বেশি পরিচিত। ধান, ভুট্টা, আলু চাষে তারা দিনরাত কাজ করে। খরা বা বন্যায় ফসল নষ্ট হলে পরিবার চালাতে তাদের দিনমজুরিতে নামতে হয়।
৮. গারো (Garo) – ময়মনসিংহ ও শেরপুর
গারোরা পাহাড়ি জমিতে ধান ও আনারস চাষ করে। পাশাপাশি বন থেকে শাকপাতা ও ফল সংগ্রহ করে খাবারের যোগান দেয়। নারীরা প্রথাগতভাবে খাদ্য সংরক্ষণ ও সংগ্রহে বড় ভূমিকা রাখে।
৯. ওরাঁও (Oraon) – রাজশাহী, রংপুর অঞ্চল
ওরাঁও জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক। অন্যের জমিতে কাজ করে অল্প ফসলের ভাগ নিয়েই তাদের সংসার চলে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তারা খরা ও অভাব-অনটনের মুখে পড়ে।
১০. কোচ (Koch) – উত্তরবঙ্গ
কোচ জনগোষ্ঠী ধান চাষ ও মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষায় নদীর ভাঙন ও জমি হারানোয় তাদের খাবারের জোগাড় কঠিন হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো প্রতিদিন খাবারের জন্য যে পরিশ্রম করে, তা আধুনিক সমাজে কল্পনাই করা যায় না। তবে তাদের এই পরিশ্রম ও প্রাকৃতিক জ্ঞানই মানবজাতির কাছে এক অমূল্য সম্পদ।

