সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা অন্ধকার অধ্যায়গুলো যেন আলম সরদারের জীবনের মতোই ভয়াবহ এবং অপ্রত্যাশিত—কিন্তু তিনি ফিরে আসেননি সেই ডাকাত দলে, যদিও ডাক পেয়েছেন বারবার। সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের এই সাধারণ মানুষটি, যার ফরসা চেহারা, মুখে দাড়ি, পরনে পোলো শার্ট আর ট্রাউজার, এখন ইজিবাইকের চালকের আসনে বসে সংসার চালান, চোখে-মুখে প্রশান্তির এক অদ্ভুত আলো ঝরিয়ে। চুনা নদীর ওপারে সেই সুন্দরবন, যেখানে মৃত্যুর ছায়া তার সঙ্গী ছিল, আজ তার জন্য শুধু অতীতের এক কালো স্মৃতি—এখন তিনি ভালোবাসার সংসারের ভরসায় বাঁচছেন, যেন নদীর ঢেউয়ের মতো অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনের তীরে এসে থেমেছেন।
পরিচিত অনেক আত্মসমর্পণকারীই আবার দস্যুতার অন্ধকারে ডুবে গেছে, তাদের ফোনের ডাকে সাড়া দিয়ে—কিন্তু আলম সরদারের হৃদয়ে সেই ডাকের প্রলোভন কোনোদিনই জায়গা পায়নি। বারবার চেষ্টা করেও তাকে টানতে পারেনি সেই দল, কারণ তার কোলে এখন তিন সন্তান আর স্ত্রীর মুখের হাসি, যা তার জন্য সবচেয়ে বড় শান্তির উৎস। এই ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালানোর সরলতায় তিনি খুঁজে পেয়েছেন জীবনের সত্যিকারের আনন্দ, যেন একটা ঝড়ো রাতের পর ভোরের আলোয় মিলিত হয়েছে সেই অপূর্ব শান্তি, যা তার অতীতের যন্ত্রণাকে ধুয়ে দিয়েছে।
আলমের জীবন যেন এক দুঃখের উপন্যাসের মতো শুরু হয়েছে—জন্মের মাত্র তিন মাস পর মা-বাবা আলাদা হয়ে যান, নানির কোলে বেড়ে ওঠেন তিনি, ছোটবেলা থেকেই মামার সঙ্গে সুন্দরবনের জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া শিকার করতে যান। লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না, ১৭ বছর বয়সে মামা মারা যান, নানির অনুরোধে বিয়ে হয়, দুবেলার খাবার জোগাড়ও হয় কষ্টে। অভাবের সেই কালো ছায়ায় এলাকার ডাকাতরা লোভ দেখান, বলেন, “চল, অনেক টাকা হবে”—এবং ২০০৮ সালে সেই প্রলোভনে আলম যোগ দেন ডাকাত দলে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝলেন, এ কাজ তার নয়; পরিচিত জেলেদের জিম্মি করে টাকা আদায় করতে হয়, বনের মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি, এক ঘণ্টাও শান্তিতে ঘুম নেই। নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘ডাকাত’, বাড়ি ফেরার পথ বন্ধ।
মাস ছয়েক পর সুন্দরবন ছেড়ে যশোরের বেনাপোলে চলে যান, বাসা ভাড়া নেন, তুলা কেনাবেচায় কাজ শুরু করেন, সিম পাল্টে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেন। সবকিছু ভালো চলছিল, হঠাৎ খুলনার এক অস্ত্রকারবারীর ফোন আসে—আবার সুন্দরবনে ফিরতে চাপ দেয়। রাজি না হওয়ায় সেদিনই র্যাব ধরে ফেলে, অস্ত্রের খোঁজ করে মামলা করে জেলে পাঠায়। ১১ মাস জেল খেটে বের হন অসুস্থ শরীরে, পেটে অপারেশন, হাঁটাচলা করতেও কষ্ট। এর মধ্যে খবর আসে, সুন্দরবনে দুই বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে এক জেলে মারা গেছে, সেই হত্যা মামলায় তার নামও আসামির তালিকায় ঢুকে যায়—যদিও তখন তিনি লোকালয়ে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন! উপায়ান্তর না দেখে আবার সুন্দরবনে পালাতে হয়।
হুলিয়া জারি হয় তার নামে, কয়েক বছর ডাকাত দল চালানোর পর ২০১৫ সালে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে থাকতেই খবর পান, সরকার বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছে। সুন্দরবনের কুখ্যাত মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, আলমের মনেও জাগে স্বাভাবিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আবার সুন্দরবনে ফিরে সঙ্গীদের উৎসাহ দেন আত্মসমর্পণে। ২০১৬ সালের ৮ মে ১৪ জন ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার আটটি গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সরকারের দেওয়া এক লাখ টাকায় কিনেন পুরোনো ইজিবাইক, সেদিন থেকে শুরু নতুন জীবন। সম্প্রতি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন, চোখে-মুখে প্রশান্তির ছাপ। বলেন, “অতীতের ভুল আর ফিরতে চাই না। এই ইজিবাইক আমার সংসারের ভরসা, এই পথেই আমার শান্তি।” মুন্সিগঞ্জ থেকে নওয়াবেঁকী, বুড়িগোয়ালিনী, শ্যামনগর পর্যন্ত ইজিবাইক চালিয়ে তিনি এখন জীবনের সেই সরল পথে চলেছেন, যা তার হৃদয়কে ভরিয়ে দিয়েছে অপার আশা আর গর্বের অনুভূতিতে—যেন সুন্দরবনের একটা সবুজ পাতা তার মতোই অন্ধকার ছেড়ে আলোর দিকে মুখ তুলেছে।

