logo
ads

হ্যালো, সভ্যতার পৃথিবী! আসছে... জারোয়া জনগোষ্ঠী

ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়, কোলকাতা থেকে

প্রকাশকাল: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৯ পি.এম
হ্যালো, সভ্যতার পৃথিবী! আসছে... জারোয়া জনগোষ্ঠী

বর্তমান বাংলা

আন্দামানের গভীর, গাঢ় সবুজ জঙ্গলের মাঝে, যেখানে পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো চুঁইয়ে পড়ে, যেখানে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন মিশে যায় বাতাসের সুরে, সেখানে বাস করে এক প্রাচীন জনগোষ্ঠী—জারোয়া। তাদের কালো, ঝকঝকে ত্বক যেন জঙ্গলের মাটির মতো গভীর, চোখে মিশে আছে হাজার বছরের গল্প, আর তাদের নীরব পায়ের ছন্দে লুকিয়ে আছে বনভূমির সঙ্গে অটুট বন্ধন। এই জারোয়ারা, পৃথিবীর প্রাচীনতম মানুষের উত্তরাধিকারী, আজ ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছে সভ্যতার দিকে। তাদের হাত নাড়াচাড়া, তাদের মুখের হাসি, আর সেই কাঁচা, আদিম কণ্ঠে উচ্চারিত “হ্যালো” যেন এক সিনেমার দৃশ্য—যেখানে অতীত আর বর্তমান মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

কল্পনা করুন, একটি সকাল, যখন কুয়াশা জঙ্গলের গাছগাছালির মাঝে জড়িয়ে আছে। দূরে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ, আর কাছে পাখির ডাক। এই প্রাকৃতিক মঞ্চে, জারোয়ারা তাদের দিন শুরু করে। হাতে ধনুক-তির, কাঁধে বোনা ঝুড়ি, তারা পাহাড়ের পথ ধরে হাঁটছে। তাদের পায়ের নীচে শুকনো পাতা মচমচ করছে, আর তাদের চোখে মিশে আছে কৌতূহল আর সতর্কতা। এই মানুষগুলো, যারা হাজার বছর ধরে বাইরের জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিল, আজ এক নতুন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের হাসিতে মিশে আছে ভয় আর বিস্ময়, সন্দেহ আর সম্ভাবনা।

জারোয়া জাতির সংখ্যা মাত্র ২৫০ থেকে ৪০০। তাদের ভাষা? এক রহস্যময় ধাঁধা, যা গবেষকরাও পুরোপুরি উন্মোচন করতে পারেননি। তাদের জীবনধারা? জঙ্গলের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত যে, মনে হয় তারা প্রকৃতিরই একটি অংশ। তারা শিকার করে, মাছ ধরে, বনের ফল আর শিকড় সংগ্রহ করে। তাদের পোশাক সামান্য, কিন্তু তাদের জীবনের সরলতায় লুকিয়ে আছে এক অপূর্ব সৌন্দর্য। তবু, আজ তারা ধীরে ধীরে পরিবর্তনের পথে। পর্যটকদের হাতে দেওয়া রঙিন কাপড়, খাবারের প্যাকেট, আর আধুনিক জগতের ছোঁয়া তাদের জীবনে নতুন রঙ যোগ করছে। প্রতিটি “হ্যালো” তাদের পক্ষ থেকে একটি আমন্ত্রণ—একটি নতুন সম্পর্কের শুরু।

কিন্তু এই পথ মসৃণ নয়। কল্পনা করুন একটি দৃশ্য: একদিকে জঙ্গলের নীরবতা, আর অন্যদিকে হাইওয়ের গাড়ির হর্ন। পর্যটকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, চোরাশিকারিদের লোভী চোখ, আর আধুনিকতার ধাক্কা—সব মিলিয়ে জারোয়াদের জীবন আজও ঝুঁকির মুখে। অতীতের স্মৃতি তাদের তাড়া করে। ১৯৯৭ সালে হাম রোগের প্রকোপে তাদের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে, আন্দামানের এই দ্বীপগুলো ছিল কুখ্যাত বন্দীশালা। জারোয়ারা, যারা তখনও জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল, তাদের স্বাধীনতা ছিল তাদের একমাত্র সম্পদ। আজও সেই স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই তাদের জীবনের একটি অংশ।

তবুও, তারা থেমে নেই। কল্পনা করুন, একটি সন্ধ্যা, যখন সূর্য সমুদ্রের বুকে ডুবে যাচ্ছে। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এক জারোয়া যুবক দূরের আলোকিত শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটি প্লাস্টিকের বোতল, যা এক পর্যটক দিয়ে গেছে। তার চোখে প্রশ্ন: এই নতুন জগৎ কী নিয়ে আসবে? তার পাশে এক শিশু, হয়তো প্রথমবার একটি রঙিন টি-শার্ট পরে হাসছে। এই দৃশ্য যেন একটি সেতু—অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে।

পর্যটকদের জন্য জারোয়ারা আজও এক রহস্যময় আকর্ষণ। কিন্তু এই আকর্ষণের মাঝে রয়েছে দায়িত্ব। ভারত সরকারের কঠোর নিয়ম রয়েছে—জারোয়াদের খাদ্য বা উপহার দেওয়া নিষিদ্ধ, তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নিষেধ। দূর থেকে দেখা, তাদের জীবনধারাকে সম্মান করা—এটাই নিয়ম। কারণ, তাদের সংস্কৃতি, তাদের প্রাকৃতিক জীবন অক্ষুণ্ণ রাখা আমাদের দায়িত্ব।

এই গল্প যেন একটি সিনেমার ক্লাইম্যাক্স। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে জারোয়ারা হাত নাড়ছে, তাদের চোখে জ্বলছে আশা আর সাহস। তাদের “হ্যালো” শুধু একটি শব্দ নয়, একটি ঘোষণা—“আমরা এখানে আছি, আমরা বেঁচে আছি, আমরা নতুন পথে হাঁটছি।” এই হ্যালো পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয়, আদিম আর আধুনিকের মধ্যে একটি সেতু গড়া সম্ভব। এই গল্প শুধু জারোয়াদের নয়, আমাদের সকলের—যারা অতীতকে সম্মান করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ