logo
ads

ময়মনসিংহে ১১টি সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি

প্রকাশকাল: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪২ পি.এম
ময়মনসিংহে ১১টি সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল

প্রতিকী ছবি

ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ১১টি সংবাদপত্রের ঘোষণাপত্র (ডিক্লারেশন) বাতিলের আকস্মিক সিদ্ধান্তে স্থানীয় সাংবাদিক সমাজে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর ২০২৫) জেলা প্রশাসন এই কঠোর আদেশ জারি করলেও বিষয়টি সোমবার (১৩ অক্টোবর ২০২৫) প্রকাশ্যে আসার পর থেকে স্থানীয় সাংবাদিক ও পাঠকদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ময়মনসিংহের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, এবং সম্পাদক ও প্রকাশকরা আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এই বাতিলকৃত পত্রিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে দৈনিক ঈষিকা (সম্পাদক: মরহুম আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার), দৈনিক বিশ্বের মুখপত্র (সম্পাদক: এনবিএম ইব্রাহীম খলিল রহিম), দৈনিক দেশের খবর (সম্পাদক: এফএমএ ছালাম), হৃদয়ে বাংলাদেশ (সম্পাদক: ফরিদা ইয়াসমীন রত্না), দৈনিক আজকের ময়মনসিংহ (সম্পাদক: মো. শামসুল আলম খান), সাপ্তাহিক পরিধি (সম্পাদক: বিকাশ রায়), দৈনিক আলোকিত ময়মনসিংহ ও দৈনিক দিগন্ত বাংলা (সম্পাদক: আ ন ম ফারুক), দৈনিক কিষানের দেশ (সম্পাদক: ওমর ফারুক), দৈনিক জাহান (প্রকাশক: রেবেকা ইয়াসমিন), এবং দৈনিক অদম্য বাংলা (সম্পাদক: নাসির উদ্দিন আহমেদ)। এই পত্রিকাগুলো বহু বছর ধরে ময়মনসিংহের স্থানীয় সংবাদ, কৃষি, শিক্ষা ও সমাজের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে এসেছে, কিন্তু এখন তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।

জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) উম্মে হাবীবা মীরা জানিয়েছেন, ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন, ১৯৭৩ এর ধারা লঙ্ঘনের কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই পত্রিকাগুলো অনুমোদিত ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়নি এবং নিয়মিত প্রকাশনার শর্ত পূরণ করেনি। এছাড়া, গত ১০-১৩ এপ্রিলের সংস্করণে এই পত্রিকাগুলোর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাতায় হুবহু একই প্রতিবেদন, ছবি ও তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়েছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও আইনের পরিপন্থী।” তবে এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মানোন্নয়নের জন্য গৃহীত বলে তিনি দাবি করেছেন।

এই ঘটনার পটভূমি গত ৮ এপ্রিল ২০২৫-এর ঘটনা। ওই সময় ১৩টি পত্রিকার বিরুদ্ধে হুবহু প্রতিবেদন প্রকাশের অভিযোগে জেলা প্রশাসন শো-কজ নোটিশ জারি করে। ১৬ এপ্রিল নোটিশ দেওয়ার পর ১৮ মে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এই ১৩টি পত্রিকার মধ্যে দৈনিক সবুজ (সম্পাদক: মো. আফসর উদ্দিন) এবং দৈনিক নিউ টাইমস (সম্পাদক: এমএ মতিন) শো-কজের জবাবে সন্তোষজনক তথ্য দিতে পেরে বেঁচে যায়। কিন্তু বাকি ১১টি পত্রিকার ভাগ্যে জুটেছে বাতিলের আদেশ, যা এখন তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলেছে।

সম্পাদক ও প্রকাশকদের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। দৈনিক দেশের খবর পত্রিকার সম্পাদক এফএমএ ছালাম বলেন, “আমরা এখনো বাতিলের চিঠি হাতে পাইনি। এটি একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত। আমাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা হাইকোর্টে রিট দায়ের করব।” একইভাবে, দৈনিক জাহান পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হাসিম উদ্দিন বলেন, “চিঠি না পাওয়ায় আমরা বিস্মিত। এটি স্থানীয় সাংবাদিকতার উপর আঘাত। আমরা আইনি পথে লড়ব।” দৈনিক আলোকিত ময়মনসিংহ ও দৈনিক দিগন্ত বাংলার সম্পাদক আ ন ম ফারুক বলেন, “আমরা তদন্তে সহযোগিতা করেছি, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত। আমরা আইনের আশ্রয় নেব।” এই সম্পাদকদের কণ্ঠে শুধু ক্ষোভ নয়, নিজেদের পত্রিকার অস্তিত্ব বাঁচানোর তীব্র আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে।

এই ঘটনা স্থানীয় সাংবাদিক সমাজে ব্যাপক শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা এটিকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক চাপের অভিযোগ তুললেও জেলা প্রশাসন তা অস্বীকার করেছে। স্থানীয় সাংবাদিক নেতা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “এই পত্রিকাগুলো ময়মনসিংহের সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরত। এগুলো বন্ধ হলে স্থানীয় সংবাদের প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কথা বলব।” সাংবাদিকদের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত তাদের পেশাগত ভবিষ্যৎ ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে, ছাপাখানা ও প্রকাশনা আইন, ১৯৭৩ এর ধারা ১২(৩) অনুযায়ী, সম্পাদক ও প্রকাশকরা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন। তারা দাবি করতে পারেন যে, বাতিলের চিঠি না পাওয়ায় প্রাকৃতিক বিচারের নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। এছাড়া, তদন্তে ত্রুটি বা অসমানুপাতিক শাস্তির অভিযোগও উত্থাপন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে পূর্ববর্তী নজিরে, যেমন দৈনিক যায়যায়দিন (২০২৫) মামলায়, হাইকোর্ট প্রশাসনিক ত্রুটির কারণে স্টে অর্ডার জারি করেছিল। তবে আইনি লড়াই ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় স্থানীয় পত্রিকাগুলোর জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এই সিদ্ধান্তের ফলে ময়মনসিংহের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই পত্রিকাগুলো স্থানীয় কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজের বিভিন্ন ইস্যু তুলে ধরত, যা এখন বন্ধের পথে। সাংবাদিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে, এবং পাঠকরা তাদের পরিচিত সংবাদপত্র হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। এই ঘটনা শুধু ময়মনসিংহ নয়, বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে বৃহত্তর প্রশ্ন তুলেছে। সম্পাদকদের আইনি লড়াই ও আদালতের সিদ্ধান্ত এই সংকটের পরবর্তী দিক নির্ধারণ করবে। তবে এই মুহূর্তে ময়মনসিংহের সাংবাদিক সমাজ এক গভীর উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন গুনছে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ