কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর বালাবাড়ী গ্রামে বুধবার সন্ধ্যার অন্ধকার যেন একটা নির্মম ছায়া নেমে এলো—মাদকের বিষাক্ত আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এক নাতির হাতে দাদার জীবনশেষ। ৮০ বছরের আসকার আলী, যাঁর নামটা ছিল গ্রামের শান্তির প্রতীক, লাঠির কঠিন আঘাতে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে, যেন একটা ভাঙা মাটির কলসির মতো। পরিবারের ঘরে যে শান্তি ছিল, সেটা এক মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল—শুধু একটা শিকলের খটখটানির শব্দ আর রক্তের লাল রঙে ভরে উঠলো সেই বাড়ির চত্বর। এ যেন মাদকের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক পরিবারের কান্নার গল্প, যা গ্রামের প্রতিটি হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল বেদনার ঢেউ তুলে, আর সমাজকে জাগিয়ে তুললো একটা সতর্কবাণীর মতো: এই বিষ কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের সন্তানদের?
ঘটনাটা ঘটলো কেদার ইউনিয়নের বালাবাড়ীতে, যেখানে আসকার আলী, মৃত্যু মন্তু শেখের ছেলে, বয়সের ছাপে ধীরগতিতে দিন কাটাতেন। তাঁর দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল মতিনের ছেলে আলমগীর হোসেন, যে একসময় ঢাকায় বাসের সহকারী হয়ে স্বপ্ন দেখতো ভালো জীবনের, সেই স্বপ্নটা মাদকের ধোঁয়ায় গলে গিয়েছিল। কিছুদিন হলো সে বাড়ি ফিরে এসেছে, কিন্তু মনটা যেন একটা ঝড়ের মতো অস্থির—মাদকের প্রভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিকলে বেঁধে রাখা ছিল তাকে পরিবারের লোকেরা। বুধবার সন্ধ্যায় শিকল পাড়ানোর ঝামেলায় সে প্রথমে দাদাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, তারপর কাঠের চেলা তুলে মাথায় আঘাত করে। আঘাতটা এতটাই নির্মম যে মাথা ফেটে যায়, রক্তের ঝরণে মাটি ভিজে যায়—যেন একটা অন্ধকার ছায়া গ্রাস করে নেয় সেই বৃদ্ধের শেষ শ্বাস। পরিবারের লোকেরা তাড়াতাড়ি তাঁকে ভূরুঙ্গামারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়, কিন্তু চিকিৎসকরা শুধু মৃত্যুর ঘোষণা দেন—ডান চোখ আর মাথায় গভীর ক্ষতের সাক্ষ্য রেখে। এলাকার লোকেরা বলছেন, আলমগীরের চোখে ছিল শুধু উন্মাদনা, কোনো অনুশোচনা নয়; ঘটনার পর সে পলাতক, যেন মাদকের অন্ধকারে লুকিয়ে গেছে কোথাও।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস এম আবু সায়েমের কণ্ঠে ছিল গভীর দুঃখ—তিনি বললেন, আসকারকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে, আঘাতের চিহ্নগুলো যেন একটা হৃদয়বিদারক ছবি। কচাকাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানান, ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ কুড়িগ্রাম মর্গে পাঠানো হয়েছে সকালে, আর হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে—যেন আইনের হাতটা এই অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টায়। কিন্তু এই ঘটনা শুধু একটা পরিবারের কান্না নয়, এটা সমাজের একটা ক্ষত, যা মাদকের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের সন্তানদের জীবনে। গ্রামের লোকেরা চোখের জলে বলছেন, আসকার ছিলেন তাঁদের আলোর মতো, যিনি গল্প বলে শিশুদের মন ভরাতেন; এখন সেই গল্প শুধু স্মৃতির ধুলোয় মিশে যাবে। আলমগীরের মতো যুবকরা কেন এমন হয়ে যায়? মাদকের এই নির্মম জাল থেকে কীভাবে রক্ষা পাবো আমরা? এই প্রশ্নগুলো যেন বালাবাড়ীর বাতাসে ভাসছে, একটা অশ্রুর ফোঁটা হয়ে ঝরছে প্রতিটি ঘরে—আশা করি, এই বেদনা থেকে উঠে আসবে একটা আন্দোলন, যা মাদকের অন্ধকারকে দূর করে আলোর পথ দেখাবে, যাতে আর কোনো দাদা নাতির হাতে প্রাণ হারায় না।

