খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী সড়ক—যেন এক অদৃশ্য শিকল, যা এলাকার হাজারো মানুষের জীবনকে বেঁধে রেখেছে দুর্ভোগের কারাগারে। বছরের পর বছর সংস্কারের অপেক্ষায় জর্জরিত এই পথটি, বড় বড় খানাখন্দে ভরা, মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঘুগরাকাটি বাজার থেকে বাগালী লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটারের এই রাস্তা, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কাঁচা অবস্থায়—যেন এক অমোঘ অভিশাপ, যা প্রতিদিন শত শত পথিকের কষ্টকে গভীর করে। একটু বৃষ্টি পড়লেই গর্তগুলো পানিতে ভরে যায়, চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, আর জীবন যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায়। স্থানীয়রা বলেন, এই রাস্তা শুধু পথ নয়, এটি তাদের স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ—কোথাও আশা নেই, কোথাও শান্তি নেই।
সকালের আলোয়, যখন সূর্যের রশ্মি পড়ে এই ধূলিময় পথে, তখন শুরু হয় এক অদম্য সংগ্রাম। লালুয়া বাগালী মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দিকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ছায়ায় ছায়া হয়ে পড়ে গর্তের ছায়া। কোমলমতি বাচ্চারা, বই-প্যান্ডেল কাঁধে নিয়ে, প্রতিদিন এই ফাঁদ পার হতে চেষ্টা করে। এক শিক্ষার্থী, চোখে অশ্রু ঝুলিয়ে বলে, “যখনই পা রাখি, কাঁচা রাস্তায় পা পিছলে যায়। গর্তে পড়ে বই ভিজে যায়, ফিরে যেতে হয় বাড়ি। ক্লাস মিস হয়, স্বপ্নগুলো ক্রমশ ম্লান হয়ে যায়।” রাস্তার পাশ দিয়ে যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা—যেখানে শিক্ষা ও ঈমানের আলো জ্বলার কথা, সেখানে আজ শুধু কষ্টের ছায়া। বৃষ্টির দিনে, যখন পানি জমে যায়, তখন শিক্ষার্থীরা যেন এক অজানা যুদ্ধে লড়ে—কখনো পা পিছলে পড়ে, কখনো বইয়ের পাতা ছিঁড়ে যায়। এই দৃশ্য যেন এক হৃদয়বিদারক চিত্র, যা মনে করিয়ে দেয়: শিক্ষার পথ যদি এমন কাঁটাতারে হয়, তাহলে ভবিষ্যতের আলো কোথায়?
স্থানীয় বাসিন্দাদের কষ্টের গল্প শুনলে বুক কেঁপে ওঠে। এক পল্লী চিকিৎসক, কণ্ঠস্বরে দুঃখ মিশিয়ে বলেন, “প্রতিবার ভোট দিয়ে প্রতিনিধিদের আসনে বসাই, তারা আশ্বাস দিয়ে যায় রাস্তা ঠিক করে দেবে। কিন্তু কথা শুধু কথা—কাজের চিহ্ন নেই। আমরা কি শুধু ভোটের মেশিন? আমাদের দুর্ভোগ দেখবে কে?” তাঁর চোখে জমে আছে অসহায়ত্বের জল, যা বছরের পর বছরের উপেক্ষায় গভীর হয়েছে। ব্যবসায়ী, কৃষক, রোগী—সবাই এই রাস্তার শিকার। এক কৃষক বলেন, “পণ্য বাজারে নিয়ে যাওয়া যায় না, যান চালকরা এড়িয়ে যায়। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা বেহাল, চলাচল থেমে যায়। জীবিকা চলে যায় হাতছাড়া।” রোগীদের কথা ভাবলে আরও কষ্ট হয়—জরুরি অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া যায় না, সময়ের সাথে লড়াই করতে হয় এই গর্তের সাথে। বহুবার স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই উপেক্ষা যেন এক নীরব হত্যাকারী, যা ধীরে ধীরে জনজীবনকে গ্রাস করছে।
মাষ্টার আসমাউল হোসেনের কথায় ফুটে ওঠে এলাকার যন্ত্রণা। “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই রাস্তা জরাজীর্ণ। শিক্ষার্থীরা সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারে না, ক্লাস মিস হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে এটি একটা মরণযাত্রা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করুন—নইলে এই দুর্ভোগ আর সহ্য হবে না।” তাঁর কণ্ঠে মিশে আছে এক প্রজন্মের অভিযোগ, যা শুধু রাস্তার গর্ত নয়, ভবিষ্যতের গর্তকে নির্দেশ করে। ইউপি সদস্য শাহ আলমও যোগ করেন, “দীর্ঘদিন ধরে এই রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী। শিক্ষার্থীদের কষ্ট অসীম। সড়ক ও জনপথ বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, দ্রুত সংস্কার করুন—জনসাধারণের জন্য এটি প্রাণের দাবি।”
খুলনা অঞ্চলে এমন রাস্তার অভাব নেই—সাম্প্রতিককালে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে, যেখানে মাত্র কয়েক মাসের সংস্কার কাজ ধসে পড়েছে। কিন্তু বাগালীর এই রাস্তা যেন এক নীরব সাক্ষী, যা স্থানীয়দের কষ্টকে আরও গভীর করে। সরকারি দপ্তরের দরজায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা এই মানুষগুলোর চোখে আজ শুধু আশা নয়, এক অটল দৃঢ়তা। তারা চান, এই মৃত্যুর ফাঁদ থেকে মুক্তি—একটা পাকা রাস্তা, যা জীবনকে আবার গতি দেয়। জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার না হলে, এই কষ্টের গল্প আরও বিষাক্ত হবে, আর হাজারো হৃদয়ে জমবে অসম্ভবের অশ্রু।

