আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেরপুর সদর-১ (শেরপুর-১) আসনটি এবার পরিণত হয়েছে এক রণাঙ্গনে, যেখানে ভোটের রাজনীতিতে চলছে টানটান উত্তেজনা। ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে গিয়ে এবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মতো দলগুলোও ভোটের হিসাবকে অপ্রত্যাশিত জটিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে সব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের দুই ক্যারিশম্যাটিক প্রার্থী— শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা— যাদের হাত ধরেই দলটি দীর্ঘদিনের জয়-খরা কাটানোর স্বপ্ন দেখছে।
দীর্ঘদিনের জয়-খরায় ভোগা শেরপুর-১ আসন বিএনপির জন্য এক 'লৌহকঠিন দুর্গ'
শেরপুর-১ আসনটি বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে বিএনপির জন্য এক দুর্লঙ্ঘনীয় ‘লৌহকঠিন দুর্গ’ হিসেবে চিহ্নিত। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই বিএনপি এই আসনে বিজয়ের পতাকা ওড়াতে পারেনি। এই দীর্ঘদিনের জয়-খরা স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও চাপা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এইবার দলটি এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে। বিপুল সংখ্যক ভোট পাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও প্রিয়াঙ্কার হার কিংবা মাসুদের অর্ধলক্ষাধিক ভোট পাওয়া সত্ত্বেও উপজেলা নির্বাচনে পিছিয়ে পড়া— এই রহস্যের সমাধান করেই তাদের জয়ের পথ খুঁজতে হবে।
বিএনপির দুই মেরু: তারুণ্যের চমক বনাম সাংগঠনিক ভিত্তি
বিএনপি এই আসনে কার্যত দুটি শক্তিশালী শিবিরে বিভক্ত, যেখানে উভয় প্রার্থীরই রয়েছে উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন এবং ভোটের অতীত রেকর্ড। শফিকুল ইসলাম মাসুদ স্থানীয় রাজনীতিতে পরীক্ষিত এক ‘দুর্দিনের কাণ্ডারি’। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হেরে গেলেও প্রায় ৫০ হাজার ভোট বগলদাবা করতে সক্ষম হন। এই সংখ্যা তার গভীর সাংগঠনিক শিকড় এবং দলের প্রবীণ কর্মীদের মধ্যে তার অদম্য জনপ্রিয়তার পরিচায়ক।
অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের ‘পোস্টার গার্ল’ সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নজর কাড়েন। সেই নির্বাচনে তিনি বিপুল সংখ্যক ভোট লাভ করলেও স্থানীয় বিএনপি এবং তার সমর্থকরা সে সময় ভোট ডাকাতি ও নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রিয়াঙ্কার এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, কঠিন প্রতিকূলতার মাঝেও তারুণ্যের আবেদন ও উদ্দীপনা দিয়ে তিনি বিপুল ভোটারকে পোলিং বুথের দিকে টানতে সক্ষম।
ভোটের অঙ্কে জটিল সমীকরণ
বিএনপির এই অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের সুযোগ নিয়ে ভোটের ময়দানে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন আরও দুই প্রার্থী। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী, ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজে কুরআন হাফেজ রাশেদুল ইসলাম ধর্মপ্রাণ ও রক্ষণশীল ভোটারদের মাঝে তার নৈতিক ও ধর্মীয় বার্তা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন, যা ভোটের মেরুকরণে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি (এনসিপি) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসেছেন তরুণ প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার লিখন, যিনি সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখিয়ে নতুন ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই তৃতীয় পক্ষগুলো মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোটব্যাংকে আঘাত হানলে শেরপুর-১ আসনের চূড়ান্ত ফলাফল যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে, যেখানে সামান্য ভোটের ব্যবধানও নির্ধারণী ভূমিকা রাখবে।
শেরপুরের সাধারণ ভোটাররা এবার নেতৃত্ব নির্বাচনে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের কাছে এখন আর কেবল দলের প্রতীক মুখ্য নয়; প্রার্থীর সততা, জনসেবায় তার ট্র্যাক রেকর্ড এবং এলাকার মৌলিক সমস্যা সমাধানে তার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। জীবনে প্রথম ভোটার হওয়া কলেজপড়ুয়া একাধিক তরুণ ভোটার বলেন, “গণতন্ত্রের উৎসব যেন কোনোভাবেই অনিয়ম বা ভোট জালিয়াতির কারণে কলঙ্কিত না হয়। আমরা সৎ, দায়িত্বশীল ও জনকল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব চাই।”
সব মিলিয়ে, শেরপুর-১ আসনটি এবার এক কঠিন রাজনৈতিক ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। বিএনপি কি পারবে তাদের দীর্ঘদিনের ‘জয়-খরা’ কাটিয়ে এই দুর্গ জয় করতে, নাকি বহুদলীয় এই সংঘর্ষে তাদের অপেক্ষা করছে আরও একটি হতাশার ইতিহাস— তা জানতে নির্বাচনী রায় প্রকাশের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

