ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া হাজারো পরিযায়ী শ্রমিক আজ দিশেহারা। দীর্ঘদিন ধরে বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও ওড়িশা, মহারাষ্ট্র কিংবা দিল্লির মতো রাজ্যে তাদের “অবৈধ বাংলাদেশি” বলে হেনস্থা করা হচ্ছে। অনেককে আটক করা হচ্ছে, মারধর করা হচ্ছে, এমনকি সীমান্তে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশে পুশ-আউট করা হচ্ছে। অথচ পরে আবার তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে ফেরত আসতে দেওয়া হচ্ছে। এ এক ভয়াবহ অমানবিক চিত্র যা বিবিসির একটি প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে, যেখানে নিরীহ শ্রমিকরাই শিকার।
মানবতার বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড
মানবাধিকার সংস্থা Human Rights Watch (HRW) স্পষ্ট ভাষায় বলেছে — এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, কেবল ভাষা, চেহারা বা উচ্চারণের কারণে ভারতীয় নাগরিকদেরও বাংলাদেশি সন্দেহে টার্গেট করা হচ্ছে। আদালতের প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে সরাসরি বহিষ্কার — যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ভয়ংকর লঙ্ঘন।
CJP (Citizens for Justice and Peace) জানিয়েছে, এটি আসলে রাজনৈতিকভাবে উস্কে দেওয়া এক ধরনের ভাষাভিত্তিক বৈষম্য, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। একই সুরে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “এটা কেবল অভিবাসনের প্রশ্ন নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে কাজ।”
সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মে থেকে জুনের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার মুসলিম শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এদের অধিকাংশেরই হাতে বৈধ পরিচয়পত্র ছিল, কিন্তু শুধু ভাষা ও চেহারার কারণে তারা সন্দেহভাজন হয়েছেন।
আসাম রাজ্যে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। স্থানীয় ট্রাইব্যুনাল প্রায় ৩০ হাজার বাঙালি মুসলিমকে ‘বিদেশি নাগরিক’ বলে ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০৩ জনকে ইতোমধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস (CJP) নামের সংগঠন একটি রিপোর্টে বলেছে, ২০২৫ সালের মে মাস থেকে গোপনে পরিচালিত “অপারেশন সিন্দুর”-এর মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্য থেকে অন্তত দুই হাজার মানুষকে পুশ-আউট করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো আদালতের শুনানি বা সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
ওড়িশায় আবার একক ঘটনায় দেখা যায়, বাংলাদেশি সন্দেহে ৪৪৭ জন শ্রমিককে আটক করা হয়েছিল। তদন্তে পরে প্রমাণিত হয়, তাদের অধিকাংশই ভারতীয় নাগরিক। শেষ পর্যন্ত ৪০৩ জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকিদের এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা হয়েছে।
এই সংখ্যাগুলো প্রমাণ করে যে বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক এবং পরিকল্পিত কর্মসূচি, যার ফলে হাজার হাজার নিরীহ পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবার মানবেতর পরিস্থিতিতে পড়ছে।
শ্রমিকদের কণ্ঠে আতঙ্ক
মালদার হরিশচন্দ্রপুরের শ্রমিক মোহাম্মদ আশরাফুল হক বললেন,
“বছরের পর বছর ওড়িশায় প্লাস্টিকের জিনিস বিক্রি করেছি। কিন্তু বিজেপি সরকার আসার পর হঠাৎ আমাদের ওপর হামলা শুরু হলো। মারধর করল, জেলে ভরল। হাতে সব নথি থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাংলাদেশি বলল। শেষে ভয়ে গ্রামে ফিরে এলাম। কিন্তু এখানে তো কাজ নেই, সংসার কেমন করে চলবে?”
মুর্শিদাবাদের মেহবুব শেখ আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শোনালেন:
“মহারাষ্ট্র পুলিশ আমাদের অবৈধ বাংলাদেশি বলে সরাসরি সীমান্তে ফেলে দিল। কাগজপত্র দেখানোর সুযোগও দিল না। ভাগ্যিস পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু আজও মনে ভয়— আবার যদি কোথাও ফেলে দেয়, তবে তো মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই।”
মিলনগড় গ্রামের মোহাম্মদ খায়েরুল ইসলাম জানালেন,
“আমরা মুম্বাইতে পাইপ বসানোর কাজ করতাম। হঠাৎ করে নানা জায়গায় শুনতে পেলাম — বাংলা বললেই বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করছে। তাই আর ঝুঁকি নেই, ফিরে এসেছি গ্রামে। এখন বসে আছি, সংসার চলে না।”
অর্থনীতির ভাঁটার টান
এই হেনস্থার প্রভাব ভয়াবহভাবে পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। রেমিট্যান্সে ভর করে চলা মালদা ও মুর্শিদাবাদের বাজারগুলোতে এখন ব্যবসা প্রায় অচল। নির্মাণ সামগ্রী, পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী বিক্রি প্রায় বন্ধ। অনেক পরিবার শিশুদের বেসরকারি স্কুল থেকে সরিয়ে সরকারি স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে।
স্থানীয় এক দোকানদার আজমল হক বললেন,
“পরিযায়ী শ্রমিকরা বাইরে গিয়ে টাকা না আনলে আমাদের ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যায়। এখন দোকানপাট ফাঁকা পড়ে আছে।”
গৃহবধূ হাসিবা খাতুন আক্ষেপ করে বললেন,
“আগে মাছ-মাংস খেতাম, এখন সবজি দিয়ে চলছে সংসার। জামা ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে পরতে হয়। সন্তানকে ভালো চিকিৎসক দেখাতে পারি না, সরকারি হাসপাতালে লাইনে দাঁড়াতে হয়।”
এখনই সজাগ হওয়ার ডাক
মানবাধিকার কর্মীরা সতর্ক করেছেন — এভাবে নাগরিকদের হেনস্থা করা কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং এটি এক ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি করছে। যদি এখনই ভারতীয় জনগণ সজাগ না হয়, তবে আগামী দিনে সামাজিক বিভাজন, অর্থনৈতিক ধস ও মানবাধিকারের অবমাননা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
তাদের কথায়, “এখন নীরব থাকলে কাল হয়তো সকলেরই নাগরিক অধিকার ঝুঁকিতে পড়বে।”

