সোমবার এলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিঙ্কে একটি অপ্রত্যাশিত বিশ্বব্যাপী বিভ্রাট ঘটে। প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো—যেকোনো দেশের বা সামরিক বাহিনীর জন্য একক প্রযুক্তিনির্ভরতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
ডাউনডিটেক্টর.কমের তথ্য অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৩৭ হাজারের বেশি ব্যবহারকারী সেবা বিঘ্নের শিকার হন। বিভ্রাট এক ঘণ্টার মধ্যে অনেকাংশে সমাধান হলেও, এত বড় পরিসরে একইসঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ব্যবহারকারীদের উদ্বেগ বাড়ায়। স্টারলিঙ্ক প্রথমে তাদের ওয়েবসাইটে সমস্যার কথা স্বীকার করলেও কিছু সময়ের মধ্যে সেই বার্তাটি সরিয়ে ফেলে। বিভ্রাটের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
ইউক্রেনে এই বিভ্রাটের প্রভাব ছিল আরও বেশি গুরুতর। স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে ফ্রন্টলাইনের পুরো এলাকায় স্টারলিঙ্ক সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সেনাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ব্যাহত হয় এবং বিশেষ করে আক্রমণ ড্রোন নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়।
ইউক্রেনের আনম্যানড সিস্টেম ফোর্সের কমান্ডার মেজর রবার্ট “ম্যাগিয়ার” ব্রোভডি জানান, সামরিক অভিযানের সাফল্যের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, এর আগে গত জুলাইয়ে ১৫০ মিনিটব্যাপী বিভ্রাট পুরো সেনা কার্যক্রমকে অচল করে দিয়েছিল। ব্রোভডি স্পষ্টভাবে সতর্ক করেন যে, একক সেবা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীলতা ইউক্রেনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।
স্টারলিঙ্ক বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি ব্যবহারকারীকে লো-আর্থ অরবিট (LEO) স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। প্রচলিত জিওস্টেশনারি (GEO) স্যাটেলাইটের তুলনায় এ প্রযুক্তি অনেক দ্রুত ও কম লেটেন্সির জন্য পরিচিত। বিশেষ করে দুর্বল অবকাঠামো বা যুদ্ধক্ষেত্রে এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে সোমবারের বিভ্রাট দেখিয়েছে, উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের নেটওয়ার্ক পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের উচিত একাধিক স্যাটেলাইট সেবা একসঙ্গে ব্যবহার করা। বর্তমানে যুক্তরাজ্যভিত্তিক OneWeb ইতিমধ্যেই ইউক্রেনে ২০০০টিরও বেশি টার্মিনাল সরবরাহ করেছে, যা স্টারলিঙ্কের মতোই লো-আর্থ অরবিট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং কম লেটেন্সি সুবিধা দেয়। অন্যদিকে Viasat ও HughesNet এর মতো জিওস্টেশনারি সেবা কিছুটা স্থিতিশীল হলেও উচ্চ লেটেন্সির কারণে তাৎক্ষণিক সামরিক অপারেশনের জন্য উপযুক্ত নয়।
ভবিষ্যতের দিক থেকেও কয়েকটি সম্ভাবনা রয়েছে। অ্যামাজনের Project Kuiper ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সেবা চালু করার পরিকল্পনা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রকল্প IRIS² ২০২৭ সালে কার্যক্রম শুরু করলে তা ইউক্রেনসহ গোটা ইউরোপের জন্য একটি শক্তিশালী বিকল্প অবকাঠামো হয়ে উঠতে পারে।
এই ঘটনার পর স্পেসএক্সের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেন বিভ্রাট ঘটল, কতটা এলাকা প্রভাবিত হলো, এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঝুঁকি কমাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে—এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এমন সেবাদাতার স্বচ্ছতা আরও বেশি প্রয়োজন, যাতে ব্যবহারকারীরা ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন।
স্টারলিঙ্কের বিভ্রাট দেখিয়েছে, আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাযোগ অবকাঠামো কতটা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ইউক্রেনের মতো দেশগুলোর জন্য স্টারলিঙ্ক অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী, তবে এটিই একমাত্র সমাধান নয়। OneWeb, ভবিষ্যতের Project Kuiper কিংবা IRIS² এর মতো সেবা সমন্বিতভাবে ব্যবহার করলে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীদের জন্যও এটি একটি সতর্ক সংকেত—কোনো একক প্রযুক্তি বা সেবার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকা আজকের ডিজিটাল যুগে বিপজ্জনক হতে পারে।

