বিশ্বজুড়েই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল ভূমির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমছে। জমি হারানো, বন উজাড়, শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য এবং আধুনিক সমাজের সাংস্কৃতিক চাপে তারা টিকে থাকার লড়াই করছে।
গবেষকদের মতে, শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই অন্তত অর্ধশত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে, যাদের অনেকেই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
বাংলাদেশে বিলুপ্তির পথে থাকা কয়েকটি নৃগোষ্ঠী
১. ম্রো (Mro)
বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠী বর্তমানে গুরুতর সংকটে। বন উজাড়, ভূমি দখল ও জীবিকার অনিশ্চয়তা তাদের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলেছে। সংখ্যা দ্রুত কমছে, তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে।
২. চাক (Chak)
খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বসবাসরত চাক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। নিজস্ব ভাষা বিলুপ্তির পথে, কারণ নতুন প্রজন্ম চাক ভাষার বদলে বাংলা ব্যবহার করছে।
৩. খিয়াং (Khiyang)
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে খিয়াং অন্যতম। এখন তাদের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে আলাদা জাতিগত পরিচয় ধরে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
৪. পাংখোয়া (Pangkhua)
বান্দরবানে সীমিত সংখ্যক পাংখোয়া পরিবার রয়েছে। মিশ্র বিয়ে ও সাংস্কৃতিক চাপে এদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
৫. লুসাই (Lushai)
মিজোরামের সঙ্গে আত্মীয়তা থাকা লুসাই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকশ’ জন। নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।
সমতল এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীও হুমকির মুখে
শুধু পাহাড় নয়, উত্তরবঙ্গ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো, সাঁওতাল, ওরাঁওসহ সমতল এলাকার নৃগোষ্ঠীগুলোও টিকে থাকার লড়াই করছে। বনভূমি হারানো, কৃষিজমি দখল ও দারিদ্র্যের কারণে তাদের তরুণ প্রজন্ম শহরমুখী হচ্ছে। এর ফলে ভাষা ও লোকজ সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার আকা, দক্ষিণ আমেরিকার ইয়াঘান কিংবা আন্দামান দ্বীপের ওনগে জাতিগোষ্ঠীর মতোই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোও একই হুমকির মুখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক জানান—
“ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো কেবল একটি জাতিগত গোষ্ঠী নয়, বরং একটি জ্ঞানব্যবস্থা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। তাদের হারিয়ে যাওয়া মানে মানবসভ্যতার এক বিরাট ক্ষতি।”
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। না হলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দেশের অনেক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী ইতিহাসের পাতায় কেবল স্মৃতি হয়ে থাকবে।

