ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে নবরাত্রি মানে উপবাস, সাত্ত্বিক আহার আর দেবী মায়ের প্রতি নিবেদন। নয়দিনের ভক্তিমূলক এই সময়ে দেশজুড়ে থালায় জায়গা নেয় সাবুদানা খিচুড়ি, কুট্টুর রুটি, ফল আর পনিরের পদ। পেঁয়াজ-রসুন তো দূরের কথা, মাছ-মাংসের ছায়াও থাকে না। কিন্তু এ দৃশ্যপট বদলে যায় বাংলায়। এখানে নবরাত্রি মানে দুর্গাপূজার আগমনী ঘণ্টা। আর সেই উৎসবের রঙে ভেসে ওঠে ইলিশ-মাছ, কোশা মাংস, মুরগির ঝোল আর রাস্তায় গরম গরম কাটলেট।
উৎসব মানেই ভোজন
বাংলায় নবরাত্রি কখনো কেবল উপবাসে সীমাবদ্ধ হয়নি। বরং এটি দুর্গা মায়ের আগমনের আনন্দকে ঘিরে এক মহোৎসব। উপবাস নয়, এখানে গুরুত্ব পেয়েছে ভোজন, পারিবারিক মিলন আর আনন্দ-আড্ডা। পুষ্টিবিদ থেকে ইতিহাসবিদ সবাই একমত—বাংলার খাদ্যসংস্কৃতি ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণে মাছ-মাংসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
বাংলা নদী-বেষ্টিত উর্বর ভূখণ্ড। ফলে মাছ বাঙালির চিরায়ত খাদ্য। ইতিহাসবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেন, বাংলায় উৎসবে মাছ-মাংস ভক্ষণ দেবীকে নিবেদন করারই এক রূপ। কালিপূজায় ছাগবলির পর সেই মাংস প্রসাদ হিসেবে রান্না করে ভাগ করা হয়। দুর্গাপূজার ভোগেও খিচুড়ি, ভাজা সবজির পাশাপাশি কোথাও কোথাও মাছ-মাংস দেখা যায়।
অন্যদিকে, বৈষ্ণব প্রভাবিত উত্তর ভারতের অঞ্চলে নিরামিষভোজকে শুদ্ধতা ও ভক্তির প্রতীক ধরা হয়। বাংলার শক্তিপূজার ধারা আবার দেবীর কাছে নিরামিষ-আমিষ উভয় নিবেদনকেই পবিত্র হিসেবে দেখে।
আবহাওয়া ও অভ্যাস
বাংলার আর্দ্র আবহাওয়া আর নদীমাতৃক ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য মাছকে এখানে প্রধান প্রোটিন উৎস করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই গড়ে উঠেছে খাদ্যাভ্যাস। তাই নবরাত্রিতে নয়দিন মাছ-মাংস ছেড়ে দেওয়া এখানে কখনো সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠেনি।
বাঙালির নবরাত্রির মেনু
কোশা মাংস: ধীর আঁচে রান্না করা ঘন মাটন কারি, লুচির সেরা সঙ্গী।
ইলিশ মাছ: সরষে ভাপে বা ভেজে পরিবেশিত প্রিয়তমা ইলিশ।
আলুসহ মুরগির ঝোল: ঘরোয়া প্রিয় পদ, বিশেষত সপ্তাহান্তে।
মাটন বিরিয়ানি: আলুসহ কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি।
ভোগ: প্যান্ডেলে ভক্তদের জন্য খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি আর পায়েশ।
রাস্তার খাবার: ফুচকা, এগ রোল, মোগলাই পরোটা, চপ, কাটলেট—সব মিলিয়ে এক উৎসবমুখর বৈচিত্র্য।
পূর্ব ও পশ্চিমের পার্থক্য
যেখানে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট বা রাজস্থানে নবরাত্রি মানেই কুট্টুর রুটি আর সাত্ত্বিক ভোজন, সেখানে বাংলায় দুর্গাপূজা প্যান্ডেলের পাশে গরম গরম বিরিয়ানি বা মাছ ভাজার গন্ধই উৎসবের স্বাদ। এ পার্থক্য কোনো অবমাননা নয়, বরং আঞ্চলিক সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
বৈচিত্র্যের উৎসব
ভারতের নবরাত্রি এক হলেও তার খাদ্যসংস্কৃতি অঞ্চলভেদে আলাদা। উত্তর ভারতে সাবুদানা খিচুড়ি, দক্ষিণে সুনডল, গুজরাটে ফারালি ঢোকলা, আর বাংলায় কোশা মাংস—সব মিলেই নবরাত্রি হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় এক উৎসব।
শেষমেশ এটিই প্রমাণ করে—খাবার শুধু পেট ভরায় না, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বাংলায় নবরাত্রি মানে ভক্তি আর ভোজন—দুইয়ের সমন্বয়।

