প্রেমের উপমা কখনো নদীর মতো নরম, কখনো ঝড়ের মতো প্রবল—কিন্তু যখন তা পরিবারের বাঁধন ভেঙে পড়ে, তখন বেদনা শুধু একজনের নয়, সমগ্র সমাজের হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলায় এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যা প্রেমের নামে অস্বাভাবিকতা, আবেগের অন্ধত্ব এবং সমাজের দ্বৈত মানদণ্ডের কঠোর ছবি তুলে ধরেছে। ৬০ বছরের এক বয়স্ক নানা এবং তার ১৮ বছরের নাতনির মধ্যে এক বছরের লুকানো সম্পর্ক—এই সংবাদটি শুধু একটি খবর নয়, এটি পরিবারের ভাঙন, নারীর অবস্থান এবং গ্রামীণ সমাজের অসংবেদনশীলতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। আসুন, এই ঘটনার সূত্র ধরে দেখি, কীভাবে অনুভূতির এই জটিল জাল সমাজের ক্ষত স্পর্শ করে।
লুকানো প্রেম থেকে প্রকাশিত বিশৃঙ্খলা
বেলকুচি সদর ইউনিয়নের ছোটবেড়াখালুয়া গ্রামে বাস করেন মোহাম্মদ কামাল মির্জা। তার ছেলে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন মির্জা (বয়স প্রায় ২২-২৩, অনুমানমূলক) গত দুই-আড়াই মাস আগে শাহজাদপুরে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী—যার বয়স মাত্র ১৮ বছর—একটি পরিবার থেকে এসেছিলেন, যেখানে অভিভাবকের অনুপস্থিতি ছিল স্পষ্ট। বিয়ের পর থেকে স্ত্রীর ব্যবহারে অস্বস্তি বোধ করছিলেন নাসির। স্ত্রীর অল্প বয়সকে কারণ মনে করে তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন, ভেবেছিলেন সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার রাতে সন্দেহের সীমা অতিক্রম করে যায়। স্ত্রীকে প্রশ্ন করলে, কিছুক্ষণের দ্বিধার পর তিনি স্বীকার করেন যে তার সম্পর্ক আছে—নিজের নানার সাথে।
এই স্বীকারোক্তি শুধু একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসঘাতকতা নয়, এটি পরিবারের মূল ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। নানা, যিনি ৬০ বছরের বয়সী এবং স্ত্রীর মাতামহ—তার সাথে এক বছরের লুকানো প্রেম। পরের দিন নাসির কৌশল করে নানা-শ্বশুরকে (স্ত্রীর নানা) বাড়িতে ডেকে আনেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সম্মতি দেন। রাগে ফেটে পড়ে নাসির এবং তার বাবা কামাল মির্জা নানা-শ্বশুরকে মারধর করেন। ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসীর চাপে নাসির শ্বশুরবাড়ি থেকে নানাকে ফোন করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। রাতে তাকে শ্বশুরের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্ত্রী এখনও নাসিরের বাড়িতেই আছেন, কিন্তু পরিবারের মধ্যে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল মতিন ফকিরের সাথে কথা বললে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে বিস্তারিত বলেন, শ্বশুরবাড়িতে অভিভাবক না থাকায় তারা কামাল মির্জাকে জানান যে অভিভাবক এলে সবাইকে ডাকা হোক। রাতে শোনা যায়, শ্বশুর এসেছিলেন কিন্তু কাউকে না জানিয়ে 'স্ট্যাম্পের উপর সই' দিয়ে (অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক বা চাপে সমঝোতা) বিষয়টা মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। মামলা হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কামাল মির্জার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি।
অনুভূতি ও আবেগের জটিলতা: প্রেম না বেদনা?
প্রেম কি শুধুমাত্র বয়সের সীমানা মানে? নাকি এটি একটি অন্ধ শক্তি, যা সমাজের নিয়মকে উপেক্ষা করে? এই ঘটনায় ১৮ বছরের এক তরুণীর জীবনে প্রবেশ করে ৬০ বছরের এক বৃদ্ধের অনুভূতি—এটি কি সত্যিকারের প্রেম, নাকি ক্ষমতার অপব্যবহার? বাংলা সাহিত্যে প্রেমের উপমা প্রায়ই দেখা যায় 'ফুলের মতো নরম, কিন্তু কাঁটার মতো আঘাতকারী'। এখানে সেই কাঁটা সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলেছে পরিবারের বন্ধন। স্ত্রীর অল্প বয়স, দ্বিতীয় বিবাহের চাপ, এবং নানার সাথে লুকানো সম্পর্ক—এগুলো কি তার মানসিক অস্থিরতার ফল? নাকি গ্রামীণ সমাজের যৌথ পরিবারে নারীর সীমিত স্বাধীনতার প্রতিফলন?
নাসিরের বর্ণনায় স্ত্রীর 'অল্প বয়স'কে তিনি প্রথমে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু স্বীকারোক্তির পর রাগ এবং মারধরের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এখানে আবেগের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট: প্রেমের বেদনা যে একজনের নয়, তা পুরো পরিবারকে গ্রাস করে। নাতনির দৃষ্টিকোণ থেকে এটি হয়তো এক অজানা আকর্ষণের ফাঁদ, যা তার অপরিপক্ক মনকে বাঁধিয়েছে। কিন্তু সমাজের চোখে এটি অসম্ভব, অস্বাভাবিক—এমনকি অপরাধমূলক।
সমাজের অসঙ্গতি: দ্বৈত মানদণ্ডের আয়না
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বাল্যবিবাহ এখনও একটি কলঙ্ক, কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকে দারিদ্র্য, অভিভাবকের অনুপস্থিতি এবং নারীর অধিকারের অভাব। এই স্ত্রীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সে, যা আইনত সীমান্ত, কিন্তু তার পরিবারে অভিভাবক না থাকায় এটি একটি 'স্ট্যাম্পের সই'য়ের মতো অনানুষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। সমাজ যখন একদিকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলে, অন্যদিকে চাপে বা লুকিয়ে এমন বিবাহ ঘটায়—এটাই অসঙ্গতি।
এই ঘটনায় মারধর, গোপন সমঝোতা এবং মামলার অনিশ্চয়তা দেখিয়ে দেয় যে নারীর কণ্ঠস্বর কতটা দমিত। স্থানীয় নেতা মতিন ফকিরের কথায়, অভিভাবকের অনুপস্থিতি সবকিছুকে জটিল করে তুলেছে। সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে স্পষ্ট: নারীর প্রেমকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু তার পেছনের কারণগুলো (মানসিক চাপ, অপরিপক্কতা) উপেক্ষিত। এটি শুধু একটি পরিবারের নয়, সমগ্র গ্রামীণ বাংলাদেশের সমস্যা—যেখানে প্রেমের নামে বেদনা বাড়ে, এবং সমাজের অসংবেদনশীলতা ক্ষত গভীর করে।
বেদনা থেকে শিক্ষা
এই সংবাদটি শুধু একটি স্ক্যান্ডাল নয়, এটি আমাদের প্রশ্ন করে: প্রেমের সীমানা কোথায়? সমাজ কি নারীকে সত্যিকারের স্বাধীনতা দেয়, নাকি শুধু নিয়ন্ত্রণ করে? বেলকুচির এই ছোট গ্রাম থেকে উঠে আসা কণ্ঠস্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অনুভূতির জটিলতা বুঝতে হলে সমাজকে তার অসঙ্গতি মেনে নিতে হবে। যদি এই ঘটনা থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া যায়, তাহলে তা হলো: প্রেমের উপমা সুন্দর হতে পারে, কিন্তু বেদনা ছাড়া তা অসম্পূর্ণ। আশা করি, এই পরিবারের সদস্যরা শান্তি খুঁজে পাবেন, এবং সমাজ একটু বেশি সহানুভূতিশীল হবে।

