logo
ads

রংপুরে অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক: দুই শতাধিক গরুর মৃত্যু, আক্রান্ত বহু মানুষ

রংপুর ব্যুরো

প্রকাশকাল: ৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৪ পি.এম
রংপুরে অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক: দুই শতাধিক গরুর মৃত্যু, আক্রান্ত বহু মানুষ

নিজস্ব

রংপুরের ধানক্ষেতের সবুজ কোলে, যেখানে গরুর ডাক মিশে থাকতো জীবনের সুর, সেখানে আজ নেমে এসেছে অ্যানথ্রাক্সের বিষাক্ত ছায়া—গত দুই মাসে দুই শতাধিক গরুর অকালান্ত এবং অর্ধশতাধিক মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া এই সংক্রামক রোগ যেন উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। পশুবাহিত এই ভয়াবহ রোগটি মূলত অসচেতনতার ফল—অসুস্থ গরু জবাই, মাংস কাটাকাটি বা খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে, যা জুলাই-সেপ্টেম্বরে পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় প্রাদুর্ভাব দেখিয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১১ জন হলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ—পীরগাছায় দুজনের মৃত্যু, অর্ধশতাধিক মানুষের শরীরে উপসর্গ, এবং আইইডিসিআর-এর নমুনা পরীক্ষায় আটজনের শরীরে রোগ শনাক্ত। এই দুর্দান্ত রোগ, যা গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায় কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে নয়, আজ রংপুরের গ্রামগুলোকে আতঙ্কে ভরিয়ে তুলেছে—যেন প্রত্যেকটা ঘরে কাঁপছে অসুস্থ গরুর ছায়া।

মিঠাপুকুরের ইমাদপুর ইউনিয়নে অসুস্থ গরু জবাই ও মাংস কাটার পর কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন—যা দেখিয়ে দিচ্ছে অজ্ঞতার কী নির্মম মূল্য। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এম এ হালিম লাবলু গলা ধরে বলছেন, "আক্রান্তদের বেশিরভাগই গরু জবাই ও মাংস কাটাকাটির সময় সংস্পর্শে এসেছেন। অ্যানথ্রাক্স গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে নয়। তাই অসুস্থ গরু জবাই বা মাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে।" এই কথায় মিশে আছে কত সতর্কতার আহ্বান—কারণ রোগের প্রধান লক্ষণ চামড়ায় ফোসকা, জ্বর, এবং দেরিতে চিকিৎসা না নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, তিন উপজেলায় ১২ লাখের বেশি গরু-ছাগলের মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ আক্রান্ত, গত দুই মাসে দুই শতাধিক গরু মারা গেছে। পীরগাছায় দেড় লাখের বেশি পশু আক্রান্ত, কিন্তু বরাদ্দ এসেছে মাত্র ৫৩ হাজার টিকা—আরও ৫০ হাজার টিকার চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এই ঘাটতি যেন রোগের আগুনকে আরও জ্বালিয়ে দিচ্ছে।পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল বলছেন, "অ্যানথ্রাক্স এখন নিয়ন্ত্রণে আছে, আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।" কিন্তু জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদের কথা শুনে হৃদয় ভারী হয়— "আগস্ট থেকেই টিকা কার্যক্রম চলছে, তবে দেরিতে নমুনা পরীক্ষা হওয়ায় এখন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আশপাশের জেলা ও উপজেলাতেও টিকা কার্যক্রম চালু আছে।" এই অ্যানথ্রাক্স, যা ব্যাকটেরিয়া Bacillus anthracis-এর কারণে হয়, বাংলাদেশে এন্ডেমিক—২০১৫ সালের বড় প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বছরে বছরে ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে। রংপুরে এই ব্রেকআউট অগাস্ট মাসে শুরু হয়েছে, যখন পীরগাছায় ১৩ জন আক্রান্ত, দুজনের মৃত্যু হয়েছে, এবং সাম্প্রতিক অক্টোবরে কাউনিয়া, মিঠাপুকুরে ছড়িয়ে পড়েছে—আইইডিসিআর-এর ল্যাবে ১৭ জনের নমুনা পজিটিভ, মোট ২৩টি সাসপেক্টেড কেস। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামেও ছড়াচ্ছে, যেখানে ১৬৫,০০০-এর বেশি পশু টিকা দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসুস্থ গরু জবাই বন্ধ ও সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাহিন সুলতানা বলছেন, "আক্রান্ত তিন উপজেলায় তিনটি মেডিক্যাল টিম গঠন করে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং স্থানীয়দের সচেতন করা হচ্ছে যেন অসুস্থ গরু জবাই না করা হয়। আইইডিসিআরকে জানানো হয়েছে এবং প্রতিটি উপজেলাকে সতর্ক করা হয়েছে। অ্যানথ্রাক্সের অ্যান্টিবায়োটিক পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত আছে। কোথাও সংক্রান্ত দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে সরবরাহ করছি।" এই চিকিৎসা যেন একটা আশার রশ্মি, কিন্তু রোগের ছায়ায় কাঁপছে গ্রামের প্রত্যেকটা ঘর—কারণ অ্যানথ্রাক্সের চামড়ায় ফোসকা, ফুসফুসে শ্বাসকষ্ট বা পেটের সমস্যা দ্রুত ছড়ায়, এবং দেরিতে চিকিৎসা না নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।

রংপুরের এই অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, অজ্ঞতা আর অসচেতনতার কী নির্মম মূল্য—আশা করি, টিকা কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে, সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে, এবং এই রোগের ছায়া সরে যাবে উত্তরাঞ্চলের আকাশ থেকে। কারণ, গরুর ঘর ছাড়া কৃষকের হাতে ফসলের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ