পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া—যেন এক নীরব যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে চিকিৎসার নামে বিক্রি হয়েছে ‘বিষাক্ত আশা’। বাজার থেকে উপজেলা চত্বর পর্যন্ত, আকর্ষণীয় সাইনবোর্ড আর নামমাত্র ফি'র প্রলোভনে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু এদের অধিকাংশেরই নেই যথাযথ লাইসেন্স, প্রশিক্ষিত ডাক্তার বা স্বাস্থ্যবিধির ছায়া। অদক্ষ হাতে চলে ল্যাব টেস্ট, ভুল রিপোর্টে বিভ্রান্ত হয় সাধারণ মানুষ, আর ভুল চিকিৎসায় জীবন হয়ে ওঠে চিরকালের কান্নার গান। এখানে জীবনের দাম যেন এক ফি'র খাতায় মাপা হয়—যেখানে ব্যবসায়ীর লোভই রাজত্ব করে, আর জনস্বাস্থ্য হয়ে দাঁড়ায় এক অদৃশ্য শিকার। স্থানীয় সূত্র বলছে, এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু অনুমোদিত মাত্র কয়েকটি। এই অরাজকতা যেন এক বিষাক্ত নদী, যা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে হাজারো পরিবারের স্বপ্ন।
হরিপদ দাড়িয়ার (৬০) গল্প শুনলে বুক কেঁপে ওঠে। বড়শৌলা গ্রামের এই হতদরিদ্র বাবা, তার মৃত পিতা বেনুরাম চন্দ্র দাড়িয়ার স্মৃতিতে বেঁচে আছেন। ২৭ জুন, ২০২৫— তার পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় ভুল চিকিৎসায়। আজও সেই যন্ত্রণায় তার দিনরাত কাটে, পরিবারের সব সদস্যের চোখে জমে অশ্রু। “আমার বাবার মতো আমিও একদিন সেই চেয়ারে বসব, কিন্তু কে দেখবে আমাদের?”—হরিপদের কণ্ঠে মিশে আছে এক প্রজন্মের অসহায়ত্ব। এমন ঘটনা এখানে একা নয়; ভুল ইনজেকশন থেকে আঘাত পর্যন্ত, প্রতিদিনই হয় জীবনের ফাঁদে পড়া। এক নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বলেন, “এক ক্লিনিকে ভুল রিপোর্টে ক্যান্সারের ধারণায় একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু তারা দায় এড়াতে বলে, ‘আরেকটা টেস্ট করুন’—যেন জীবনটা একটা খেলনা।”
সকাল হলেই শুরু হয় রোগী ধরার লড়াই। পথের ধারে দাঁড়িয়ে দালালচক্র চিৎকার করে, “সস্তায় টেস্ট, ভালো ডাক্তার!” নামমাত্র ফি'র লোভে টানে ভিতরে, তারপর একগাদা টেস্টের খাতা পুরিয়ে দেয়। অদক্ষ টেকনিশিয়ানদের হাতে চলে আল্ট্রাসাউন্ড, রক্তপরীক্ষা—ভুল রিপোর্টে রোগী বিভ্রান্ত, চিকিৎসা হয় বিপরীত। ক্লিনিকগুলোতে নার্সের নামে কেবল সাদা অ্যাপ্রন পরা অপ্রশিক্ষিত মহিলা, যাদের হাতে ইনজেকশন দিয়ে হয় শিরা ছিঁড়ে যাওয়া। কিছু সেন্টার অন্য জায়গায় টেস্ট করে নিজ নামে রিপোর্ট চালায়, আর দালালের সিন্ডিকেট রাজত্ব করে রাজনৈতিক ছায়ায়। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের আর্থিক লোভ দেখিয়ে টানে বেসরকারি ক্লিনিকে, আর অ্যাম্বুলেন্সের সিন্ডিকেট নেয় অতিরিক্ত ভাড়া—যেন রোগীদের জীবন একটা ব্যবসায়িক পণ্য। এই অরাজকতা যেন এক কালো ছায়া, যা মঠবাড়িয়ার আকাশকে ঢেকে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য সচেতন মহলের কণ্ঠে উঠছে ক্রোধের সুর। “এটা জনস্বাস্থ্যের সাথে খেলা—একটা ভুল রিপোর্টে পরিবার নষ্ট হয়ে যায়,” বলেন এক স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী। পিরোজপুর জেলায় অনুমোদনহীন ক্লিনিকের সমস্যা নতুন নয়; সাম্প্রতিককালে মৌলভীবাজারে ৩টি অবৈধ ডায়াগনস্টিক বন্ধ হয়েছে, কিন্তু মঠবাড়িয়ায় এখনও নীরবতা। স্থানীয়রা দাবি করছেন, অবিলম্বে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ, দোষীদের আইনি শাস্তি, আর সরকারি হাসপাতালের সেবা উন্নয়ন। প্রশাসনের নজরদারি আর স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযান ছাড়া এই বিষাক্ত চক্র থামবে না। মঠবাড়িয়ার রাস্তায় আজও ভেসে বেড়ায় রোগীদের কান্না, কিন্তু আশার আলো জ্বালানোর দায় এখনও অপূর্ণ—যেন একদিন ফিরবে স্বাস্থ্যের সত্যিকারের হাসি।

