মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ২নং ধানীসাফা ইউনিয়নের উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের বলেশ্বর নদের তীরে আকনবাড়ি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের কারুকার্যে খচিত মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের আলো ছড়ানো “মমিন মসজিদ” বা “মমিনের কাঠ মসজিদ”। প্রায় ১১০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শন।
জাতীয় যাদুঘর প্রকাশিত Centenary Commemorative Volume ও Mosque Architecture in Bangladesh–এ অন্তর্ভুক্ত, এবং ইউনেস্কো কর্তৃক প্রকাশিত স্বচিত্র প্রতিবেদনে বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন মসজিদের তালিকায় এর স্থান ২৩তম।
দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মে মমিন মসজিদ
সম্পূর্ণ কাঠের কারুকাজে তৈরি মসজিদটি এক অপূর্ব শিল্পনিদর্শন। ইন্দো–পারসিক ও ইউরোপীয় ধারার মিশ্রণে স্থপতির নিজস্ব মৌলিক উৎকর্ষে নির্মিত এই স্থাপত্য বাংলাদেশে অদ্বিতীয়।
চৌচালা টিনসেড ছাদের মসজিদের দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট, প্রস্থ ১৮ ফুট এবং মাঝখানে কোনো খুঁটি নেই। চারপাশের কাঠের দেয়াল বহু অংশে বিভক্ত। উত্তর–দক্ষিণে ৪টি ও পূর্ব–পশ্চিমে ৮টি মিলিয়ে মোট ১২টি জানালা রয়েছে।
কারুকার্যখচিত দরজা ও মেহরাবে বিদ্যমান ক্যালিগ্রাফি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। প্রবেশমুখের উপরের বাম দিকে আরবি অক্ষরে ইসলামের চার খলিফার নাম ও মাঝখানে হযরত মোহাম্মদ (সা.)–এর নাম অলংকৃত করা হয়েছে। ডানদিকে লেখা রয়েছে প্রতিষ্ঠার বাংলা সাল।
দুষ্প্রাপ্য লোহাকাঠ, শাল ও বার্মা সেগুন কাঠের ওপর প্রাকৃতিক রঙের প্রলেপে মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন রূপ পেয়েছে। কাঠের দেয়ালে ইসলামিক সংস্কৃতি, ক্যালিগ্রাফি ও ফুলপাতার নকশায় ফুটে উঠেছে অনন্য নান্দনিকতা।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— মসজিদের নির্মাণে কোনো তারকাঁটা বা লোহা ব্যবহার করা হয়নি। বাংলাদেশের একমাত্র দারুশিল্পে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শনটির স্থপতি ছিলেন মমিনউদ্দিন আকন।
সমস্যাগ্রস্ত মমিন মসজিদ
বাস্তব চিত্রে দেখা যায়, চারপাশে ময়লা-আবর্জনা ও ঝোপঝাড়ে ঘেরা মসজিদটির রুগ্ণ অবস্থা। দেয়ালের বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয়ে গেছে, পানির কারণে চৌকাঠ ক্ষয়ে পড়ছে।
বর্ষাকালে ছাদে ফাঁটল দিয়ে পানি পড়ে মুসল্লিরা নামাজ আদায়ে বিপাকে পড়েন। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মসজিদের ওপর একটি অতিরিক্ত চালা নির্মাণ জরুরি।
প্রতিষ্ঠাতার উত্তরসূরী ও স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ ও উদ্বেগ। দর্শনার্থীদের জন্য লাইব্রেরি, মিনি মিউজিয়াম ও পার্ক সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প গ্রহণের দাবি উঠেছে।
দেশি–বিদেশি পর্যটকদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই; তাদের জন্য বাংলো ও পাঠাগার স্থাপন প্রয়োজন। মমিন মসজিদকে সুন্দর পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কাঠের কারুকার্যে সমৃদ্ধ এই অনন্য মসজিদটির সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি
মমিনউদ্দিন আকনের দৌহিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের থমাস জেফারসন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মোঃ শহিদুল্লাহ আকন, মসজিদটির প্রত্নগুরুত্ব ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে “মমিন মসজিদ: স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা” শীর্ষক বই রচনা করেন।
এর প্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মসজিদটিকে “সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ” হিসেবে ঘোষণা করে তালিকাভুক্ত করে। যদিও ২০০৮ ও ২০২১ সালে আংশিক সংস্কার করা হয়, পূর্ণ সুরক্ষা এখনো হয়নি।
মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল ও কারিগর
জানা যায়, ১৯১৩ সালে স্থানীয় সমাজসেবক মমিনউদ্দিন আকনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয়। শুরুতে সাড়ে তিন শতাংশ জমিতে নির্মিত হলেও পরবর্তীতে তা বেড়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছায়।
ধর্মপ্রাণ মমিনউদ্দিন আকন সাত বছর (১৯১৩–১৯২০) সময় নিয়ে ২২ জন কাঠমিস্ত্রির সহায়তায় মসজিদটি নির্মাণ করেন। মিয়ানমার, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে আনা শাল, বার্মা সেগুন ও লোহাকাঠ ব্যবহৃত হয়।
প্রধান কারিগর ছিলেন জেলার স্বরূপকাঠীর শ্রী হরকুমার মিস্ত্রি— এমন তথ্য জানান মমিনউদ্দিনের দৌহিত্র মোঃ আবুল কালাম আজাদ আকন।
কে এই মমিনউদ্দিন আকন?
পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের সম্ভ্রান্ত আকন পরিবারে মমিনউদ্দিন আকন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৩ সালে। মৃত্যু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর, শুক্রবার।
৬ বছর বয়সে পিতা ইব্রাহিম আকনকে হারান তিনি। কৈশোরে নোয়াখালীর এক মাওলানার কাছে আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ধর্মীয় চেতনা ও রুচিবোধ থেকেই মসজিদ নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান তিনি।
মমিনউদ্দিন আকন ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কৃষক নেতা ইদ্রিস (ইদির) হাওলাদারের নাতি এবং মৌলভী ইব্রাহিম আকনের পুত্র।
তার পরিবার ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার অনুসারী ছিলেন। দাদা ইদির হাওলাদার ও তাঁর দুই সহোদর খিদির ও ইউসুব (ইসাব) হাওলাদার দক্ষিণাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
তারা বোলাকি শাহর সহযোদ্ধা হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৭৯২ সালে বোলাকি শাহ প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
এই আন্দোলনের সূত্র ধরে ইদির হাওলাদার পরিবার পরে মঠবাড়িয়ায় এসে তুষখালী ও শিংখালীর কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন (১৮৩০–১৮৭১)। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৯ সালে পিরোজপুরে মহকুমা সৃষ্টি হয়।
এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় মমিনউদ্দিনের দাদা ইদ্রিস হাওলাদার ও তাঁর সহোদরদের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস সন্নিবেশিত করেছে।
মমিন ও পূর্বপুরুষদের সমাধি
মসজিদের আশেপাশে মমিনউদ্দিন আকনের চার পুরুষের সমাধি সংরক্ষিত রয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
দেশের যেকোনো স্থান থেকে লঞ্চ বা বাসযোগে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার তুষখালী বন্দরে আসতে হবে। সেখান থেকে “মমিন মসজিদ সড়ক” ধরে পৌঁছানো যায় ঐতিহাসিক এই কাঠের মসজিদে।
দৌহিত্রের মন্তব্য
মমিনউদ্দিনের দৌহিত্র মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, “মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন মমিন মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এখন সময়ের দাবি।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ূম বলেন, “মসজিদটির কিছু সংস্কার করা হয়েছে। অবশিষ্ট কাজের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রতিবেদকের বক্তব্য
বাংলাদেশে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। ধর্মপ্রাণ মমিনউদ্দিন আকন কাঠের খোদাইয়ে নিস্প্রাণ বস্তুতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন, যা তাঁর ধর্মানুরাগের জীবন্ত প্রমাণ।
মমিন মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ মানে ইসলামের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের সক্রিয় তত্ত্বাবধান এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।
লেখক:
শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক
মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাব, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর
???? sharifsstyle@gmail.com

