শরৎকালের নরম আলোয় বিলাইছড়ির কেরনছড়ি দশবল বৌদ্ধ বিহার যেন একটি ধ্যানমগ্ন মঞ্চে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেখানে শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ৩১তম কঠিন চীবর দানের অনুষ্ঠানে ভিক্ষুসংঘের হাতে বস্ত্রের স্পর্শ মিলেছে শান্তির নীরব প্রার্থনায়। এই প্রাচীন বৌদ্ধ আচার, যা গৌতম বুদ্ধের সময় থেকে প্রচলিত—যেখানে একদিনের মধ্যে তুলা কেটে, সুতো বুনে, রং করে ত্রি-চীবর তৈরি করা হয়—যেন একটি অলৌকিক সৃজনশীলতার প্রতীক, যা দানশ্রেষ্ঠের পথে নিয়ে যায় নির্বাণের দ্বার। বিহারের চারপাশে ধূপের সুগন্ধ আর মন্ত্রের সুরে ভরে উঠেছে বাতাস, যেখানে গৃহীদের শ্রদ্ধা এবং ভিক্ষুদের ত্যাগ মিলে গড়ে উঠেছে একটি আধ্যাত্মিক সেতু—কষ্টের জগত থেকে মুক্তির আলোর দিকে। এই উৎসব কেবল বস্ত্র দান নয়, একটি হৃদয়ের উদযাপন, যা সমাজে ভালোবাসা আর ঐক্যের বীজ বপন করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ের কোলে এক নতুন আশার গান গেয়ে।
সকালের প্রথম পর্বে বিহারের মূলঘরে জ্বলে উঠেছে বুদ্ধপূজার দীপ, যেন সূর্যোদয়ের সাথে মিলে ধর্মের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। সংঘদান এবং অষ্টপরিস্কার দানের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, যেখানে ভিক্ষুরা নীরবে প্রণাম জেনেছেন গৃহীদের শ্রদ্ধায়। প্রধান ধর্মীয় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিলাইছড়ি বাজার সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত দেবতিষ্য থের, যাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠেছে বৌদ্ধ দর্শনের গভীরতা—কীভাবে চীবর দান করে গৃহীরা অর্জন করে পরম শান্তির পথ। বিশেষ আলোচক হিসেবে এসেছেন ফারুয়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত কমলতিষ্য ভিক্ষু, বাঙ্গালকাটা বহুমুখী বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত তেজবর্ণ ভিক্ষু, বরকলক শান্তিধাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত শাসনজ্যোতি ভিক্ষু, ধুপ্যাচর ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত শাক্যপ্রিয় ভিক্ষু প্রমুখ। তাঁদের দেশনায় যেন শ্রোতাদের হৃদয়ে জাগ্রত হয়েছে ত্যাগের আহ্বান, যা চীবরের সুতোর মতো জড়িয়ে ধরেছে জীবনের অন্ধকার কোণগুলোকে।
বিকেলের দ্বিতীয় পর্বে মূল অনুষ্ঠান যেন একটি আধ্যাত্মিক জোতস্কানে পরিণত হয়েছে—কঠিন চীবর দান সভায় ভিক্ষুসংঘের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে ত্রি-চীবর, যা হাতে তৈরির কঠোর নিয়ম মেনে সাজানো, রঙিন এবং পবিত্র। বিলাইছড়ি উপজেলা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ও পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বিলাইছড়ি শাখার সভাপতি ভদন্ত আর্যলঙ্কার মহাথেরের সভাপতিত্বে প্রধান ধর্মালোচক ভদন্ত বিপুল জ্যোতি থের ধর্ম দেশনা দিয়েছেন—কেরনছড়ি দশবল বৌদ্ধ বিহার ও কর্ণফুলী নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ যাঁরা, তাঁর কথায় ফুটে উঠেছে কঠিন চীবরের মহিমা: কীভাবে এই দান মানুষকে লৌকিক-লোকোত্তর কল্যাণের পথ দেখায়, রোগমুক্তি এবং নির্বাণের দ্বার খোলে। উপস্থিত অন্যান্য ভিক্ষুরা—এদুজ্যাছড়ি আর্যমৈত্রী বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত অভয়তিষ্য ভিক্ষু, বগাখালী ধর্ম দর্শন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত অগ্রবংশ ভিক্ষু প্রমুখ—তাঁদের দেশনায় যোগ দিয়েছেন, যেন একটি সম্মিলিত মন্ত্রের সুরে ভরে উঠেছে বিহার। এর আগে বক্তব্য রেখেছেন কঠিন চীবর দান উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক দয়া রঞ্জন চাকমা, ইউপি চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি দেওয়ান ও হেডম্যান শান্তি বিজয় চাকমা—তাঁদের কথায় ফুটে উঠেছে সমাজের ঐক্য এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের গুরুত্ব, যা চীবর দানকে একটি সামাজিক উৎসবের রূপ দিয়েছে।
সন্ধ্যার সোনালি আলোয় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়েছে বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় ফানুস বাতি উত্তোলন করে—যেন আকাশের দিকে উড়ে গেছে শত শত আলোর বিন্দু, প্রতিটি একটি প্রার্থনা বহন করে সকলের মঙ্গলের জন্য। এই ৩১তম উদযাপন যেন কেরনছড়ির পাহাড়ে একটি অমলিন স্মৃতি রেখে গেছে, যেখানে চীবরের সুতোর মতো জড়িয়ে ধরেছে সম্প্রদায়ের হৃদয়। কঠিন চীবর দানের এই অনুষ্ঠান শুধু ধর্মীয় নয়, একটি আধ্যাত্মিক জাগরণ—যা পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজকে মনে করিয়ে দেয় ত্যাগের পথে লুকিয়ে থাকা অসীম শান্তির স্বাদ। এই উৎসবে যেন ফুটে উঠেছে বৌদ্ধ দর্শনের সার—দানের মাধ্যমে মুক্তি, এবং ঐক্যের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি।

