চট্টগ্রামের শহর ও উপজেলাগুলো যেন আজ, ১২ অক্টোবর রবিবার, একটি বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছে—যেখানে টাইফয়েডের কালো ছায়া থেকে রক্ষা করার জন্য ২৪ লক্ষ ৬১ হাজার ৩৪২ শিশুর হাতে হাতে চলছে বিনামূল্যে টিকার যুদ্ধ। সারা দেশে শুরু হয়েছে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন–২০২৫, যা ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশু এবং প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অমূল্য রক্ষাকবচ—এক ডোজে ৩-৭ বছরের সুরক্ষা, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অনুমোদিত এবং হালাল সার্টিফায়েড। এই ক্যাম্পেইন, যা মে মাসের পরিকল্পনা থেকে অক্টোবরে স্থগিত হয়েছে স্বাস্থ্য সহকারীদের হরতালের কারণে, এখন স্কুল পর্যায়ে ৩১ অক্টোবর এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ১-১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে—যেন একটি মাসব্যাপী বিজয়যাত্রা, যা প্রায় ৫ কোটি শিশুর জীবনকে টাইফয়েডের নির্মম আঘাত থেকে বাঁচাবে। চট্টগ্রামে চসিকের তত্ত্বাবধানে নগরে ৮ লক্ষ ২৯ হাজার ৩০১ এবং ১৫ উপজেলায় ১৬ লক্ষ ৩২ হাজার ৪১ শিশুকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফরের কথায় ফুটে উঠেছে: “টাইফয়েড এখন বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকির নাম, যার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্রমশ বাড়ছে—এই টিকা হবে আমাদের অস্ত্র।”
চট্টগ্রামের যুদ্ধক্ষেত্র: শিশুদের রক্ষায় অক্লান্ত প্রস্তুতি
চট্টগ্রামের নগরীতে প্রবর্তক মোড়ের আইয়ুব বাচ্চু চত্বরে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ব্যবস্থাপনায়—বেলা সাড়ে ১১টায় এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “টাইফয়েড প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা গ্রহণ। অভিভাবকরা তাদের শিশুদের এই বিনামূল্যে টিকা নিতে উৎসাহিত করুন—ব্যক্তিগতভাবে কিনলে ১৪০০ টাকা খরচ, কিন্তু ক্যাম্পেইনে এটি স্বপ্নের মতো সহজ।” নগরের ১ হাজার ৫৪৬টি স্কুল এবং ৭৮৩টি আউটরিচ সাইটে ৫ লক্ষ ৩১ হাজার ১৬৭ স্কুল শিক্ষার্থী এবং ২ লক্ষ ৯৬ হাজার ৭৮৪ স্কুলবহির্ভূত শিশুকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য—৪২০ ভ্যাকসিনেটর এবং ৬২৫ স্বেচ্ছাসেবকের হাতে চলছে এই যুদ্ধ। উপজেলায় সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে ৬ হাজার ৫৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৭১ শিক্ষার্থী এবং কমিউনিটিতে ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ৯৭০ শিশুকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা—২০০ ইউনিয়নের ৬০০ ওয়ার্ডে ১ হাজার ২১৫ প্রশিক্ষিত কর্মী, ১ হাজার ৮০০ স্বেচ্ছাসেবক এবং ৬৬০ পরিদর্শকের অক্লান্ত চেষ্টায়।
সিভিল সার্জনের ৫টি সতর্ক নির্দেশ: শিশুদের নিরাপত্তায় অটল সতর্কতা
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলমের ৫টি নির্দেশনা যেন একটি অটল দুর্গ—যা শিশুদের টিকা গ্রহণকে নিরাপদ করে তুলবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীরা সকালে নাস্তা করে এবং ঢিলেঢালা জামা পরে আসুক, যাতে টিকার স্পর্শ সহজ হয়। দ্বিতীয়ত, কোনো অবস্থাতেই ক্লাসরুমে টিকা দেওয়া যাবে না—আলাদা ঘেরাও রুমে ব্যবস্থা আবশ্যক, যাতে ভীতিজনিত এডভার্স ইভেন্ট ফলোয়িং ইমুনাইজেশন (AEFI)-এর ঝুঁকি কমে। তৃতীয়ত, প্রতি কেন্দ্রে অ্যানাফাইল্যাক্সিস কিট এবং উপজেলায় AEFI কিটের ফাইনাল চেক নিশ্চিত করুন। চতুর্থত, চিকিৎসকরা ক্যাম্প এবং AEFI ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অবহিত থাকুন। পঞ্চমত, কোনো স্কুল বা মাদ্রাসা টিকা গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে অবিলম্বে সিভিল সার্জন অফিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে জানান—টিসিভি কন্ট্রোল রুমের সহায়তা নিন। এই নির্দেশনাগুলো যেন একটি শিল্ড, যা শিশুদের নিরাপত্তায় অটল সতর্কতা বজায় রাখবে।
টাইফয়েডের ভয়াবহ ছায়া: কেন এই টিকা অমোঘ অস্ত্র?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য যেন একটি কালো ছায়া—প্রতি বছর বিশ্বে ৯০ লক্ষ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ১ লক্ষ ১০ হাজার মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে এই হার অনেক বেশি—২০২১ সালে ৪ লক্ষ ৭৮ হাজার আক্রান্ত এবং ৮ হাজার মৃত্যু, যার ৬৮% শিশু। দূষিত পানি-খাবার এবং পরিচ্ছন্নতার অভাবে ছড়ানো এই রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ বাড়ছে—যা ভয়াবহ ওষুধ-প্রতিরোধী টাইফয়েডের প্রকোপ ডেকে আনছে। ডা. আবু জাফরের কথায় ফুটে উঠেছে এর গুরুত্ব: “এই টিকা গ্রহণ করলে আক্রান্ত হওয়ার হার বহুলাংশে কমবে, অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ হ্রাস পাবে।” রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই টিকা পাওয়া যাবে—জন্মনিবন্ধন সনদের ১৭ ডিজিট দিয়ে ওয়েবসাইটে (www.dghealth.gov.bd) (www.dghealth.gov.bd) নিবন্ধন করুন, কিন্তু না করলেও টিকা নেওয়া যাবে। এই ক্যাম্পেইন যেন একটি বিজয়ের ঘোষণা—চট্টগ্রামের ২৪ লক্ষ শিশুর হাসিতে ফুটে উঠবে স্বাস্থ্যের নতুন আলো, আর টাইফয়েডের অন্ধকার চিরতরে মিলিয়ে যাবে। অভিভাবকরা, আজই শিশুদের হাত ধরে টিকা কেন্দ্রে যান—কারণ এক ডোজে লুকিয়ে আছে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

