দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে প্রেস কনফারেন্সে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধে যারা আপত্তি তুলেছেন, তারা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞাত। প্রতিটি দেশের ভিতরে অন্যান্য দেশের দূতাবাসের সার্বভৌমত্ব রয়েছে। তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করা যায় না। এই সাংবাদিক সম্মেলন যদি আফগান দূতাবাসের বাইরে হতো, তাহলে ভিন্ন কথা। প্রথমে আমারও খটকা লেগেছিল, কিন্তু পরে অধ্যয়ন করে যথার্থতা খুঁজে পেয়েছি।
এবার পুরো ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা যাক:
আফগানিস্তানের বিদেশ মন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী ভারতে এসে দিল্লিস্থ আফগান দূতাবাসে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দিতে আপত্তি করেন। এই নিয়ে বওয়াল শুরু হয়েছে। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র চাঁচাছোলা ভাষায় মোদী সরকারকে গালি দিয়েছেন। সিপিআই (এম) দলের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য তীব্র ভাষায় আরএসএস বা হিন্দুত্ববাদীদের গালিগালাজ করেছেন। এছাড়া বামপন্থী এবং অন্যান্য নারীবাদীরাও এই নিয়ে ভারত সরকারকে কটাক্ষ করেছেন। এই ব্যাপারে আমার কিছুই লেখার ইচ্ছে হলো। মনে হলো, চুপ না থেকে কিছু লিখেই ফেলি। কারণ এরা আন্তর্জাতিক আইন-কানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ — এই তথ্য মানুষের জানা উচিত।
প্রথমত, ঘটনাটি ঘটেছে আফগানিস্তানের দূতাবাসে। এখানে জানিয়ে রাখি যে কোনো দেশের দূতাবাসের অভ্যন্তরে সেই দেশ কী নিয়ম-কানুন পালন করবে, সেটা তাদের নিজস্ব অধিকারের আওতায় থাকে। যেমন ভারতে আফগান দূতাবাসকে "আফগানিস্তান সার্বভৌম রাষ্ট্র" এর একটি অংশ হিসেবে ধরা হয়।
আবার আফগানিস্তানে ভারতীয় দূতাবাসে চলবে ভারতের নিয়ম, সেখানে আফগান সরকার কিছুই বলতে পারবে না। যেমন আফগানিস্তানে মহিলারা হিজাব ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে পারেন না। কিন্তু কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসের মধ্যে এই নিয়ম মেনে চলতে একজন মহিলা বাধ্য নন। সেখানে আফগান সরকার কিছুই বলতে পারবে না। তাই ভারতে আফগানিস্তানের দূতাবাসে তালিবানরা যদি মহিলাদের প্রবেশাধিকার না দেয়, সেটা তাদের ব্যাপার। ভারত সরকার এই ব্যাপারে যদি নাক গলায়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করা হবে।
তালিবানরা দেওবন্দি মুসলমান। এর মূল উৎস ভারতের উত্তরপ্রদেশে। দেওবন্দি ইসলাম মূলত আরবের ওয়াহাবি সম্প্রদায় দ্বারা প্রভাবিত, অর্থাৎ প্রকৃত ইসলাম অনুসরণ করাই তাদের কাজ। ইসলামের মধ্যে কোনো ধরনের সংস্কার তারা পছন্দ করেন না। আফগানিস্তানে তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাঁটি ইসলামিক আইন চালু করে, মহিলাদের শিক্ষার ওপর ব্যান আরোপ করেছে। অথচ এক সময় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের চাইতে বেশি ছিল। এখন সেখানে মহিলারা বিশ্ববিদ্যালয় তো দূর, এমনকি স্কুলে পর্যন্ত যেতে পারছে না। তবে কিছুটা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইদানীং মেয়েদের ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ার অনুমতি দিয়েছে তালিবান সরকার। এটি করা হয়েছে যাতে মেয়েরা সংসারের টাকাকড়ির হিসেব রাখতে পারে। তাছাড়া যেসব বাড়িতে মহিলা আছেন, সেই বাড়ির জানালা সিল করে দেওয়া হয়েছে।
মনে রাখবেন, বাংলাদেশের হেফাজতি ইসলাম সংগঠনের তেঁতুল হুজুর পর্যন্ত মেয়েদের ক্লাস সিক্সের বেশি পড়াশোনা করতে দিতে বারণ করেছেন। ভারতে মুসলিম মহিলাদের স্বাক্ষরতার হার সর্বনিম্ন। কিন্তু এই মহুয়া ম্যাডাম কিংবা বিকাশরঞ্জনকে কখনো এই নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি। সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, মুসলিম মেয়েদের ইউনিফর্মের পরিবর্তে হিজাব পরে স্কুলে যাওয়া উচিত। কর্ণাটকে কংগ্রেস দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে বলা হয়েছিল, মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে স্কুলে যাওয়ার অধিকার নিয়ে তারা আইন পাশ করবে। এছাড়া মোদী সরকার যখন ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক বাতিল করার জন্য সংসদে বিল নিয়ে এসেছিল, তখন ভারতের সিপিআই ও সিপিআই(এম) দল এই বিলের বিরোধিতা করেছে। তাই এই সব কমিউনিস্ট ও নারীবাদীরা মহিলাদের শিক্ষা কিংবা অন্যান্য অধিকার নিয়ে কতটা চিন্তিত তা আমার জানা আছে।
রাহুল গান্ধী আফগান দূতাবাসে সাংবাদিক সম্মেলনে মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় মোদী সরকারের সমালোচনা করে ট্যুইট করেছেন। একজন বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাহুল গান্ধীর জানা উচিত যে আফগানিস্তানের দূতাবাসে আফগান সরকারের নিয়ম চলে। ভারত সরকার এখানে নাক গলাতে পারে না। ভারত সরকারের দায়িত্ব হলো আফগান দূতাবাসকে সুরক্ষা প্রদান করা। কিন্তু দূতাবাস চত্বরে তারা কী ধরণের নিয়ম মেনে চলবেন, সেটা তাদের ব্যাপার। আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ অনুযায়ী ভারত সরকারের এতে নাক গলানোর অধিকার নেই।
এবার অতীতের দিকে তাকান। ১৯৭৯–৮০ সালে মধ্যপ্রদেশের সাহবানু নামের একজন তালাকপ্রাপ্তা বৃদ্ধা মহিলাকে বেঁচে থাকার জন্য সামান্য ১৭৯.২০ টাকা মাসিক খোরপোষ দিতে আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিল, সেটিকে সংসদে অর্ডিন্যান্স জারি করে খারিজ করে দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। মুসলিম ভোটারদের খুশি করতে একজন বৃদ্ধা মহিলাকে অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে কুণ্ঠিত হননি রাহুল গান্ধীর পিতা। একজন অসহায় বৃদ্ধার পাশে দাঁড়ানোর মতো শিরদাঁড়া যার পিতার ছিল না, তার পুত্র হিসেবে রাহুল গান্ধীর আগে তো নিজের পিতার এই আচরণ নিয়ে কিছু বলা উচিত। তারপর নাহয় মোদী সরকার মহিলাদের কীভাবে অপমানিত করল, সেটা নিয়ে কথা বলবেন। রাহুল গান্ধী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, বিজেপি'র সিম্বল পদ্মফুল নাকি হিংসার প্রতীক। কিন্তু রাজীব শব্দের অর্থ তো পদ্মফুল। অন্তত সাহাবানুর সঙ্গে রাজীব গান্ধী যে আচরণ করেছেন, সেটা হিংসারই প্রতীক। তাই কংগ্রেসি বা কমিউনিস্টরা এই নিয়ে বেশি কথা না বললেই ভালো। কারণ বললে পরে আমাদের মুখ খারাপ করতে হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, অন্য যেসব জায়গায় আফগান বিদেশ মন্ত্রী গেছেন, সেখানে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল। কারণ আফগান দূতাবাসের বাইরে ভারতের নিজস্ব নিয়ম-কানুন চলে। প্রমাণ হিসেবে একটি আলোচনা সভার ফটোগ্রাফ এই পোস্টের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, যেখানে আফগান বিদেশ মন্ত্রী বসে আছেন, এবং ভারতের মহিলারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ছবিতে মাঝখানে এবং পিছনের দিকে বহু মহিলা বসে রয়েছেন আফগানিস্তানের বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গে।
লেখক: মানস বন্দ্যোপাধ্যায়
জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

