logo
ads

আরাকান আর্মি-রোহিঙ্গা: নিরাপত্তা সঙ্কটে বাংলাদেশ

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

প্রকাশকাল: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩০ এ.এম
আরাকান আর্মি-রোহিঙ্গা: নিরাপত্তা সঙ্কটে বাংলাদেশ

প্রতিকী ছবি

২০১৭ সালে নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সরকারের, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের সহানুভূতির সুযোগ গ্রহণ করে তাদের নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় দেওয়া হলেও, সেই থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে জর্জরিত। আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুন, গুম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শরণার্থী শিবিরগুলোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র সংঘাতের প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্তে সরাসরি পড়ছে। বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা—নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম, থানচি, রুমা ও উখিয়ায়—পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

চট্টগ্রামের কক্সবাজারে নাফ নদী বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। এই নদীর পানি অনেক বাংলাদেশির জীবিকার উৎস হলেও এটি ভয় ও বিপর্যয়ের প্রতীকেও পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির আগ্রাসনের কারণে নাফ নদী মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অস্পষ্ট সীমান্তরেখার সুযোগে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র গোষ্ঠী। ফলে উপকূলবর্তী পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত এলাকার জেলেরা স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছে।

রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘাত সীমান্ত অতিক্রম করলে বাংলাদেশে আভ্যন্তরিন নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে সংঘাত দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাও ভেঙে দিতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবিরে পরিণত করেছে। প্রতিবছর শিবিরে প্রায় ৩২ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাড়তি উপস্থিতি স্থানীয় জনগণকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে। দীর্ঘমেয়াদি শরণার্থী অবস্থানের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড—চাঁদাবাজি, মাদক, খুন, অপহরণ ও ধর্ষণ—পুলিশ ও প্রশাসনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।

বিজিবি সূত্র জানায়, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম, থানচি, রুমা ও উখিয়া সীমান্তে অতিরিক্ত সীমান্ত রক্ষি মোতায়েন করা হয়েছে। যৌথ টহল, মাইন সচেতনতামূলক কার্যক্রম, জরুরি চিকিৎসা সহায়তা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে আরাকান আর্মি কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে নেই এবং তারা অবাধে বাংলাদেশী পাহাড়ি এলাকায় বিচরণ করছে।

আরাকান আর্মি রাখাইন জনগোষ্ঠীর তৈরি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছে। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে তাদের উপস্থিতি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান উল্লেখ করেছেন, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে কার্যত নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুধু বিলম্বিত হচ্ছে না, বরং নতুন রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের জন্য জরুরি প্রয়োজন, রোহিঙ্গা সমস্যাকে গুরুত্ব সহকারে দেখা, তহবিল বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিশ্চিত করা। গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ এবং দেশের সকল স্তরের জনগণকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন।

সারসংক্ষেপে, বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির উপস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অনিশ্চিত করছে এবং দেশের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে। এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ও সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য।

(লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক)
E-mail: gmbhuiyan@gmail.com

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ