বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগ ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে বিশ্ব রাজনীতি এক তীব্র ও নজিরবিহীন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং মানবজাতির অগ্রযাত্রাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের যে ঢেউ এসেছিল, তা এখন কর্তৃত্ববাদের পুনরুত্থান, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং আঞ্চলিক সংঘাতের তীব্রতার মুখে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে সরে আসছে, যা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে।
এই অস্থিরতার মূলে রয়েছে বেশ কয়েকটি মৌলিক কারণ। একদিকে যেমন পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে (যেমন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, এবং ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ন্যাটো দেশগুলোর মধ্যে সামরিক উত্তেজনা), তেমনি অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং প্রযুক্তিনির্ভর ভুল তথ্যের (misinformation) দ্রুত বিস্তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও গভীর করছে। বিশেষ করে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের নাজুক পরিস্থিতি (যেমন—ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত) এবং আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে সামরিক অভ্যুত্থানের মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে বর্তমানে আঞ্চলিক সংঘাতগুলো আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করছে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের বর্তমান সামরিক উন্মত্ততা, বিশেষত ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর নির্বিচার অভিযানের ফলে গাজা উপত্যকায় সংঘটিত চরম মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যা, বিশ্ব বিবেককে এক চূড়ান্ত নৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক হত্যার পাশাপাশিই শিশুদের ওপর চালানো পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড (systematic slaughter of children) এবং নারী-বৃদ্ধদের লক্ষ্যবস্তু বানানো আন্তর্জাতিক আইনের জঘন্যতম লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ। মানবিক অবকাঠামো, হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর নির্বিচার ধ্বংসের মাধ্যমে গাজাকে কার্যত মানবতাবর্জিত এক বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে।
প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নির্লজ্জ রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিদারুণ পক্ষপাতমূলক নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ করে যে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা সংকীর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে কেবল আত্মসমর্পণই করেনি, বরং তা হত্যার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপানো এই অকল্পনীয় দুর্ভোগ এবং শিশুদের জীবন কেড়ে নেওয়ার বিভীষিকা বিশ্বজুড়ে ন্যায়কামী মানুষের মধ্যে চরম বিদ্বেষ, ক্রোধ ও চরমপন্থার নতুন ঢেউ জাগিয়ে তোলার সরাসরি অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আইনের মৃত্যু এবং সভ্যতার চূড়ান্ত পতনকে চিহ্নিত করে, যা ভবিষ্যতে এক প্রতিশোধপরায়ণ, সংঘাতময় এবং স্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল বিশ্ব ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করছে।
এই ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে, একটি চরম এবং অনিবার্য ঝুঁকি হলো পারমাণবিক সংঘাতের প্রত্যাবর্তন। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে যে স্বস্তি তৈরি হয়েছিল, পরাশক্তিগুলোর বর্তমান কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা (বিশেষত রাশিয়া-ন্যাটো সামরিক উত্তেজনা) এবং আঞ্চলিক সংঘাতের আন্তর্জাতিকীকরণের কারণে তা বিলীন হতে চলেছে। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিদ্যমান “সীমারেখা অতিক্রম” করার ঝুঁকি এবং সামরিক ভুল হিসাব (miscalculation) যেকোনো আঞ্চলিক সংঘাতকে দ্রুত একটি অপ্রতিরোধ্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। সামান্যতম ভুল পদক্ষেপ বা যোগাযোগের অভাবে প্রচলিত সংঘাত মুহূর্তের মধ্যে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের দিকে মোড় নিতে পারে, যা মানবজাতির জন্য এক বিপর্যয়কর পরিণতি নিশ্চিত করবে। এই পরিস্থিতিতে, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়া এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার পুনরুত্থান বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বর্তমান অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক বা আঞ্চলিক বিষয় নয়;
“এটি মানবজাতির অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হুমকি। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বিদ্যমান অস্থিরতা কেবল আঞ্চলিক বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং তা মানবজাতির অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হুমকি, যা বিশ্বকে আরও বেশি সংঘাতপূর্ণ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করবে।”

