শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। শিউলি-ঝরা ভোরে ঘাসের আগায় শিশিরের আন্দোলন। মা এসেছেন দুয়ারে। চারদিকে শরতের সোনালি রোদের আঁচল বিছানো আর মাইকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠে ভুবন মাতোয়ারা। তারই মাঝে ক্লান্ত শরীরে ভোরের শিশির পায়ে জড়িয়ে উমা বাড়ি ফিরছে মাতৃবস্ত্রালয়ের জামাকাপড়ের প্যাকেট হাতে। আজ যে অষ্টমী। বাড়িতে উমার দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটা বসে আছে নতুন জামা পাবার আশায়। আর এক মা দুর্বল শরীরে মেয়ের ফেরার অপেক্ষায়—মেয়ে যে তার জন্য, নাতনির জন্য নতুন কাপড় আনবে সেই আশায়। এতসব ভাবতে ভাবতে উমা বাড়ির দরজায় কখন যে এসে পৌঁছে যায় তা তার খেয়ালও থাকে না। সম্বিত ফেরে মেয়ের মা ডাক শুনে।
বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিল উমা। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা। বাবা স্বপন মুদি দোকানে কাজ করতেন আর মা ছায়া লোকের বাড়িতে। উমা শুনেছিল, ওর ঠাকুরদা মারা যাবার পর কাকারা সব সম্পত্তি নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়ে বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। তখন উমার মা সন্তানসম্ভবা। বাড়ি থেকে বের হয়ে সস্ত্রীক স্বপন বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কাটোয়ায় এসে ওঠেন। সেখানেই অমল কর্মকার নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা হয়। অজান্তেই তাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবার কথা বলে স্বপন। অমলবাবু সব শুনে স্বপনকে তার মুদি দোকানের দেখাশোনার ভার দেন। মুদি দোকান ছাড়াও তার আরও ব্যবসা ছিল। দোকানের জন্য লোক খুঁজছিলেন, তাই স্বপনকে পেয়ে অমলবাবু দোকানের কাজে বহাল করলেন। সেই সঙ্গে উমার মাকেও বাড়ির কাজের জন্য রেখে দিলেন। তাদের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে ওরা থাকতে শুরু করল। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী উমাদের পরিবারকে খুব ভালোবাসতেন। এর মধ্যে উমার জন্ম হলো। আস্তে ধীরে উমা বড় হতে থাকল। এরপর স্কুলেও ভর্তি হলো। অভাবের সংসারে শান্তির বাসা বেঁধেছিল।
উমা যখন উচ্চমাধ্যমিক দেবে তখন একদিন সন্ধ্যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অমলবাবু মারা গেলেন। অমলবাবুর একমাত্র ছেলে আকাশ ব্যবসার ভার নিতে বাধ্য হয়। বড়লোক বাবার ছেলে হবার দরুণ সে বদমেজাজি ও বাউন্ডুলে প্রকৃতির ছিল। বাবার মৃত্যুতে আকাশ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অমলবাবু থাকাকালীন ছায়া শরীর খারাপের জন্য কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। অমলবাবুর চলে যাওয়া উমাদের পরিবার মেনে নিতে পারেনি। তেমনি আকাশের ব্যবহারও তাদের চিন্তায় রেখেছিল।
উমা কলেজে পড়ছে। এক শরতের সন্ধ্যায় পড়াশোনা থেকে ফেরার পর আকাশ উমাকে ডাকে। উমার শারীরিক সৌন্দর্যের কাছে অনেক মেয়েই বেমানান। তাই আকাশের কুনজর যে উমার ওপর পড়েছিল তা বোঝা গেল সেই সময়। জোর করে ভয় দেখিয়ে উমার শালীনতা নষ্ট করে আকাশ। ভয় দেখিয়ে বলে কাউকে জানালে তাদের পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এছাড়া স্বপনকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। উমা নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরে ফেরে। দেখে তার মায়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে উমা। তারপর রাতের রান্না চাপায়। নিজের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ভোলার জন্য আর মায়ের অসুস্থতায় চিন্তিত হয়ে পড়ে। স্বপন ঘরে এলে মায়ের জ্বরের কথা জানায়। তারপর দুজনকে খেতে দেয়। খাওয়া হয়ে গেলে মাকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। উমা যে খায়নি তা লক্ষ্য করে তার বাবা। মেয়েকে খাবার কথা বলাতে উমা বলে, শরীরটা ভালো লাগছে না। তাই না খেয়েই শুয়ে পড়ে। সারারাত আর দুচোখে ঘুম নেই। সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল শুধু। কানে বাজছিল আকাশের হুমকি—বাবাকে খুন করে দেবে। এভাবেই সময় বয়ে যায় আপন খেয়ালে।
এরই মাঝে উমা বুঝতে পারে তার শরীরের পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়িতে না জানিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে সে মা হতে চলেছে। এই খবর পাওয়ার পর উমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ঠিক করে আকাশকে যোগ্য জবাব দেবে। বাড়ি ফেরার পথে আকাশের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় উমার। আকাশকে ডেকে বলে এই বাচ্চার স্বীকৃতি দিতে। এবার আকাশ রুখে দাঁড়ায়। উমাকে বলে, কালই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, আমার নামে কোনো দায় চাপালে পুরো পরিবারকে শেষ করে দেব। বলেই কোমরে গোঁজা বন্দুকটা উমার কপালে ধরে। উমা ভয়ে পালিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। সন্ধ্যার হালকা অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে পাখির কিচিরমিচির ঘরে ফেরার তাড়ায়।
হালকা শীতের রাত, প্রায় এগারোটার সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় স্বপনের। বলে ওঠেন, এতো রাত্রে কে? গম্ভীর গলায় আকাশ বলে, দরজা খুলুন, না হলে দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে। এর মধ্যে উমা আর ছায়াও উঠে পড়ে। উমা বলে, তোমরা দাঁড়াও আমি দরজা খুলছি। উমা গিয়ে দরজা খোলে। আকাশ ঘরে ঢুকেই স্বপনকে বলে, কালই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। বাবা, কী করছ এসব—স্বপন বলে ওঠে। স্বপনকে কথা বলতে না দিয়ে আকাশ বলে, এই নিন আপনার বেতন, আর এই খামে তিন লাখ টাকা আছে। কাল সকাল হওয়ার আগেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কেন যাবেন? কেন বলছি, তার কোনো কৈফিয়ত আমি দেব না। যা বলছি তাই করবেন। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায় আকাশ।
আবার চিন্তায় পড়ে যায় উমা ও তার পরিবার। জিনিসপত্র গুছিয়ে আবার হবে যাযাবর জীবন। রাতের অন্ধকার সারিয়ে এবার ভোর হওয়ার পালা। উমা চোয়াল শক্ত করে বাবা-মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। তখন সবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। কিছুদূর চলার পর ওরা একটা বাস দেখতে পায়। সামনে আসতেই তিনজনে উঠে পড়ে। উমা যেন বড় হয়ে উঠেছে। কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে বাস কলকাতার ধর্মতলায় যাবে। উমার মা-বাবা আপত্তি করলেও উমা তাদের বুঝিয়ে রাজি করায়। গ্রাম্য মেয়ে বাবা-মাকে ভরসা জুগিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসে।
ধর্মতলায় পৌঁছাতে তখন সবে দুপুর। শীতটাও উধাও, তার ওপর পেটে ছুঁচো দৌড়চ্ছে। ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডের পাশের লাইন হোটেলে গিয়ে ওরা খেতে বসে। কোথায় থাকা হবে এরপর থেকে—সেই নিয়ে চলে আলোচনা। উমা গম্ভীর হয়ে বলে, বাবা, এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ। আগে খেয়ে নাও, তারপর থাকার চিন্তা করা যাবে। ওদের পাশে বসে সুজয় নামের একটি মাঝবয়সী ছেলে সব কথা শুনে এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
সুজয়ের বাড়ি শোভাবাজারে। সে তার মায়ের সঙ্গে থাকে, ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চলে মা-ছেলের। স্বপনকে ওদের বাড়ির কথা বলে সুজয়। ভাড়া ঠিক করে স্বপন পরিবার নিয়ে সেখানে গিয়ে ওঠে। উমা বাবা-মাকে বলে, চিন্তা কোরো না, যার কেউ নেই ভগবান আছে তাদের জন্য। এরপর থেকে সুজয়দের বাড়িই হলো উমাদের মাথা গোঁজার আশ্রয়। একদিন উমা তার বাবা-মাকে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া সব ঘটনা জানায়। সব শোনার পর স্বপন আকাশের আর তার মায়ের মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু উমা বাধা দিয়ে বলে, না বাবা, তুমি যেও না, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। তখন আমাদের কী হবে বলো? মেয়েকে কাঁদতে দেখে স্বপন আর কিছু না বলে মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। ছায়া উমাকে বলে, বাচ্চাটাকে নষ্ট কর, এই পাপ রেখে লাভ নেই। পরবর্তীতে তোকে বিয়ে দিতে পারব না। স্বপনও স্ত্রীর কথায় সায় দেয়। এবার উমা বেঁকে বসে—বলে, তোমরা বললেও এই পাপটা আমি করতে পারব না। আমি মেয়ে হয়ে ভ্রূণ হত্যা কিছুতেই করতে পারব না। আর বিয়ে? সে ইচ্ছে যে মরে গেছে আমার। যখন লোকে জানতে পারবে বলবে বর ছেড়ে চলে গেছে। পরিবেশ একেবারে থমথমে হয়ে যায়, যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।
এদিকে কাজের জন্য স্বপন চেষ্টা করতে থাকে। অনেক চেষ্টার পর উমার বুদ্ধিতে, সুজয়ের সহযোগিতায় পাড়ার মোড়ে সবজির দোকান দেয়। যে টাকা তিনি পেয়েছিলেন তার থেকেই। অল্প বিস্তর দোকান চলতে থাকে। বাপ-বেটি মিলে দোকান চালিয়ে খেয়ে পড়ে দিন কাটতে থাকে।
এর মধ্যে একদিন উমার শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হয়। তখন জানা যায় উমা অন্তঃসত্ত্বা। সবাই বলে উমার স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। পাড়ার লোকেদের সহানুভূতিও পায় উমা। আসলে উমার শিক্ষা আর ব্যবহারকে সকলেই পছন্দ করত। তাই উমা দোকানে থাকলে বিক্রিও বেশি হত। অবসর সময়ে পাড়ার গরিব বাচ্চাদের পড়াত উমা। এভাবে দিন কাটতে কাটতে প্রসবের সময় আসন্ন হলো। মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হলো। সেখানে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দিল উমা। সবাই খুব খুশি। সদ্যজাতকে নিয়ে উমা বাড়ি ফিরল।
এভাবেই দিন কেটে যায়, মাস ঘোরে, বছর ঘোরে। মেয়ে বড় হতে থাকে সবার আদরে। বাবার অভাব বুঝতে দেয় না। কালের ভয়াল থাবা নেমে আসে উমাদের সংসারে। একদিন সকালে দোকানে যাবার জন্য বের হতে গিয়ে বুকে ব্যথা অনুভব করেন স্বপন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মেঝেতে পড়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে উমার। এদিকে পূজোও প্রায় শেষ। বাবা মারা যাবার পর দোকান একা হাতে সামলায় উমা। এই ছোট্ট দোকান চালিয়ে মায়ের ওষুধ, মেয়ের খরচ চালানো দিনে দিনে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে মেটাতে হচ্ছে মেয়ের আবদারও।
দোকানে গেলেও উমার মনে নানা চিন্তা ভর করে। হঠাৎ একদিন উমার দোকানের নিত্যদিনের খরিদ্দার আশা দি আসে রোজকার মতো সবজি নিতে। উমার মুখে ফুটে ওঠা বিসন্নতা দেখে কী হয়েছে জানতে চায়। সব শোনার পর উমাকে অভয় দিয়ে বলে, তোমার চিন্তা নেই, তোমার কাজের ব্যবস্থা আমি করে দেব। এর থেকে অনেক বেশি আয় করতে পারবে। উমা বলে ওঠে, কবে যেতে হবে? আশা বলে, সময় করে তোমাকে নিয়ে যাব। বলে চলে যায় আশা। এই চলতে থাকে উমার দিনযাপন। প্রায় মাস খানেক পর আবার আশা আসে উমার সঙ্গে দেখা করতে ও সবজি নিতে। কথায় কথায় আশাকে বলে যায় দোকানের পর রাস্তার মোড়ে দাঁড়াতে। সেই দিনের সেই দাঁড়ানোই উমার জীবনে কালো দিন এনে দিল। অতীত ভাবতে ভাবতেই সে এতটা পথ চলে এসেছে।
সম্বিত ফেরে যখন তার মেয়ে গৌরী এসে উমার হাতের ব্যাগটা ধরে বলে, মা, আমার নতুন জামা এনেছ? দাও—বলে জামার প্যাকেট ধরে ছোট্ট মেয়েটা টান মারে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলে উমা। “মা, তুমি কাঁদছ?”—বলে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে চোখের জল মুছে দেয়। মেয়েকে কোলে নিয়ে উমা ঘরে ঢুকে মাকে প্রণাম করে। ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে বলে, যাও, এটা পরে নাও। আর মেয়েকে এই জামাটা পরিয়ে দাও। গৌরী দিদার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উমা স্নান সেরে শাড়ি পরে, মা আর মেয়েকে নিয়ে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে বেরিয়ে পড়ে। উমাকে যেন এক অন্য উমার মতো দেখাচ্ছিল। ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ, মাইকে চণ্ডীপাঠ।

