logo
ads

নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাজনাহোরকাই-র সাক্ষাৎকার

মাসুদুল হক 

প্রকাশকাল: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৩২ পি.এম
নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাজনাহোরকাই-র সাক্ষাৎকার

সংগৃহীত ছবি

[লাসলো ক্রাসনাহোরকাই একজন অসাধারণ কথাসাহিত্যিক, যাঁর লেখা তাঁকে হাঙ্গেরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও নোবেল পুরস্কারের ভূষিত করে তুলেছে। তাঁর লেখা দীর্ঘ, প্রায় অবিরাম বাক্যে গঠিত, যেখানে দর্শন, রসিকতা ও গভীর মানবিক অনুভব একসাথে মিশে যায়। তিনি বিশ্বাস করেন, ভালোবাসার মতো জটিল ও সাহসী অভিজ্ঞতাকে ছোট বাক্যে প্রকাশ করা যায় না। তাঁর ভাষা একটানা প্রবাহের মতো, যা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় বিশ্বের নানা কোণায়।

তিনি ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরিতে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের প্রথম দিকে তাঁকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি, তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। সেই সময়ের লেখা, যেমন Satantango ও The Melancholy of Resistance, দমবন্ধ করা এক বাস্তবতার প্রতিফলন। পরে, সমাজতন্ত্র পতনের পর তাঁর লেখায় এক ধরনের মুক্তি আসে। Seiobo There Below উপন্যাসে তিনি এশীয় শিল্প ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব অনুসন্ধান করেন। সাম্প্রতিক উপন্যাস Herscht 07769-এ তিনি বাখের সঙ্গীতের সঙ্গে জার্মান নব্য নাৎসিবাদের তুলনা করেছেন। সম্প্রতি The Yale Review-এ প্রকাশিত তাঁর গল্প “An Angel Passed Above Us” ইউক্রেনের যুদ্ধের কাদা-মাটির বাস্তবতার বিপরীতে প্রযুক্তিগত বৈশ্বিকীকরণের রঙিন স্বপ্ন দেখায়।এই গল্পটিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে, হারি কুনজরু, প্রখ্যাত বৃটিশ ঔপন্যাসিক, ইমেইলের মাধ্যমে লাসলো ক্রাসনাহরকাই-র সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন The Yale Review-র জন্য।সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মাসুদুল হক]

হারি কুনজরু: আপনার গল্প “An Angel Passed Above Us” ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রচিত। ইউক্রেনের যুদ্ধ আপনার কাছে কী অর্থ বহন করে? এই সংঘাত সম্পর্কে—একজন ইউরোপীয়, একজন হাঙ্গেরিয়ান এবং দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে বসবাসকারী মানুষ হিসেবে—আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আমরা জানতে চাই।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মূলত আবারও পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? আমি কী ভাবি? তাই তো?

এটা আমাকে ভীষণ আতঙ্কে ফেলে দেয়। হাঙ্গেরি ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ, আর অরবান শাসনব্যবস্থা এমন এক নজিরবিহীন অবস্থান নিয়েছে—হাঙ্গেরির ইতিহাসে প্রায় তুলনাহীন। এর একটি কারণ হলো, এতদিন পর্যন্ত আমরাই ছিলাম আক্রান্ত পক্ষ, আমরাই হেরেছি বারবার; আর অন্যদিকে, আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে হাঙ্গেরির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই বিষয়ে তথাকথিত “নিরপেক্ষতা”-র কথা বলতে পারে!

একটি দেশ কীভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে যখন রাশিয়া পাশের একটি দেশে আক্রমণ চালায়? আর প্রায় তিন বছর ধরে তারা ইউক্রেনীয়দের হত্যা করছে—এটা কি সবাই ভুলে গেছে? “এটা একটি অভ্যন্তরীণ স্লাভিক ব্যাপার”—হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেন—এর মানে কী? মানুষ মরছে, হত্যা করা হচ্ছে, আর বলা হচ্ছে এটা কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার! আর এ কথা বলছেন এমন এক দেশের নেতা—যে দেশ নিজেই ইতিহাস জুড়ে বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। অন্যদের মধ্যে রাশিয়ার দ্বারাও। আর এই রাশিয়ানরা সেই একই রাশিয়ান।

এই হাঙ্গেরীয় শাসনব্যবস্থা যেন এক মানসিক রোগের মতো। এর পেছনে রয়েছে এক অমানবিক হিসাব—“হয়তো তারা ইতিমধ্যেই আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছে, কিন্তু আমি সেটাই মেনে নেব যদি তাতে আমার মায়ের কোনো ক্ষতি না হয়।” কিন্তু তারা মায়ের ক্ষতিও করবে। তারা দুজনকেই মেরে ফেলবে। এটা বুঝতে এত কষ্ট হয় কেন?

হারি কুনজরু: “An Angel Passed Above Us” গল্পটি দুটি মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিককে নিয়ে, যারা একটি গর্তের ভিতরে রয়েছে। তাদের একজন অন্যজনকে বৈশ্বিকায়নের বিস্ময় নিয়ে একধরনের রূপকথা শুনাচ্ছে। এই রূপকথার প্রযুক্তি-আশাবাদী সুর আর বাস্তবে মৃত্যুর মুখে থাকা দুই মানুষের অবস্থা—এই দুইয়ের মধ্যে একটি তীব্র বৈপরীত্য দেখা যায়। এটি যেন দ্রুত অগ্রসরমান বিশ্বের প্রতি গল্পটির আশাবাদী দৃষ্টিকে খণ্ডন করে। আপনি কেন এই দুই উপাদানকে পাশাপাশি স্থাপন করেছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমার চোখের সামনে একটি নোংরা, পচা যুদ্ধ চলছে। পৃথিবী যেন ধীরে ধীরে এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি পারছি না। মানুষ মানুষকে হত্যা করছে—এই বিষয়টি আমি মেনে নিতে অক্ষম। হয়তো আমি মানসিকভাবে অস্বাভাবিক। একই সময়ে, ডিজিটাল জগতে ভবিষ্যতের এমন এক চিত্র আঁকা হচ্ছে যেখানে বলা হচ্ছে, প্রযুক্তির ভয়ংকর দ্রুত অগ্রগতি শীঘ্রই এক সুন্দর নতুন বিশ্ব গড়ে তুলবে। এটি সম্পূর্ণ উন্মাদনা। যখন বিশ শতকের ধাঁচের এক যুদ্ধ চলছে, তখন কেউ বলছে আমরা শিগগিরই মঙ্গল গ্রহে যাব। আমি আশা করি, পুতিন এবং তার সমর্থকরাই হোক প্রথম যাত্রী।

হারি কুনজরু: আপনার গল্পকথক জোর দিয়ে বলেন যে “তিনি ভবিষ্যতের বিশ্লেষক নন, বরং প্রবণতা, তথ্য ও বাস্তব ঘটনার বিশ্লেষক।” তিনি “বিশ্বজনীন” বা “মানসিক” স্তরে অস্বস্তি বোধ করেন। তিনি সামাজিক স্তরেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাহলে কি “ভবিষ্যৎ” সম্পর্কে জ্ঞান এই ধরনের প্রমাণভিত্তিক, “তথ্যনির্ভর” জ্ঞানের চেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক বা অধিবিদ্যাগত কিছু?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: এটা আসলেই একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন। কারণ, এই রচনায় ঘটনাগুলো কোনো সাধারণ প্রেক্ষাপটে ঘটে না; বরং, এক আহত ব্যক্তি চেষ্টা করছে আরেকজন মারাত্মকভাবে আহত ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে—তাকে আশা দিয়ে কথা বলে, এক সুন্দর নতুন পৃথিবীর কল্পনা দেখিয়ে, যেখানে সবকিছু বদলে যাবে, সবকিছু হবে চমৎকার। এখানে এক মৌলিক মানবিক প্রবৃত্তি তাকে তাড়িত করছে অন্যজনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। তাদের আর কোনো আশা নেই, আর যে ব্যক্তি ডিজিটাল ভবিষ্যতের গল্প বলছে, সেও জানে যে সে আসলে শুধু সময় কাটাচ্ছে, এই আশায় যে তাদের সঙ্গীরা হয়তো ফিরে আসবে—যদিও সে জানে, অন্যজনের মতোই, যে তাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অসম্ভব। তাই না, এই বক্তৃতার কোনো আধ্যাত্মিক বা অধিবিদ্যাগত মাত্রা নেই; বরং এটি গভীরভাবে বাস্তব—মুমূর্ষু মানুষটিকে “নিরর্থক আশার” ইঙ্গিত দিয়ে জীবিত রাখার এক প্রচেষ্টা।

হারি কুনজরু: এই প্রেক্ষাপট—একটি নৃশংস ট্রেঞ্চ যুদ্ধের সামনের সারি—আপনার লেখায় কোনোভাবে পরিচিত মনে হয়। আমি জানি, স্যুজান সনটাগ আপনাকে “অ্যাপোক্যালিপসের ওস্তাদ” বলেছেন—এ বিশেষণটি আপনার পিছু ছাড়ে না। কিন্তু যদি আপনার লেখালেখি প্রলয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে হয়, তবে তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং কিছু ধীর ও পেষণকারী বিষয়। আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কটা কী? আমরা কি অন্তিম সময়ের মধ্যে বাস করছি? নাকি আমরা কোনো ধরনের প্রলয়-পরবর্তী সময়ের মধ্যেই আছি?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: প্রলয় (অ্যাপোক্যালিপস) একক কোনো ঘটনা নয়, যেমন নতুন নিয়মে (New Testament) শেষ বিচার বা Last Judgment–এর ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে। প্রলয় একটি প্রক্রিয়া, যা অনেক দিন ধরে চলেছে এবং আরও বহু দিন ধরে চলতে থাকবে। প্রলয় এখনই ঘটছে। প্রলয় হলো এক চলমান বিচার।

আমরা কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে ভুলে থাকতে পারি; কারণ আশা সব সময় ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু ভবিষ্যৎ কখনও আসে না। তা সব সময় আসারই পথে থাকে। কেবল এখন-যা-আছে, সেটাই বিদ্যমান।

আমরা অতীত সম্পর্কে কিছুই জানি না, কারণ যাকে আমরা ‘অতীত’ বলি, তা আসলে কেবল অতীতের একটি গল্প। বাস্তবে, বর্তমানও একটি গল্প—যার ভেতরে আছে অতীতের গল্প এবং এমন এক ভবিষ্যৎ যা কখনও আসবে না। তবে অন্তত আমরা যে বর্তমানকে নিয়ে বাঁচি, সেটি বিদ্যমান। এবং একমাত্র সেটিই বিদ্যমান। নরক ও স্বর্গ দুটোই পৃথিবীতে, এখানেই রয়েছে। আমাদের তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। অথচ আমরা অপেক্ষা করি—আশার সুরে নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে।

হারি কুনজরু: আপনি বিশেষ করে "Seiobo There Below" বইটিতে শিল্প নিয়ে অনেক লিখেছেন। ভবিষ্যৎ কল্পনা করার বা সেটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিল্পের ভূমিকা কী? শিল্পে কি কোনো রকম মুক্তির বা পরিত্রাণের শক্তি আছে?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: শিল্প হলো মানবতার এক অসাধারণ প্রতিক্রিয়া—আমাদের নিয়তির অন্তর্নিহিত হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতির প্রতি। সৌন্দর্য বিদ্যমান। এটি এমন এক সীমার ওপারে অবস্থান করে, যেখানে এসে আমাদের থামতে হয়; আমরা আর এগোতে পারি না সৌন্দর্যকে ধরতে বা স্পর্শ করতে—শুধু দূর থেকে তাকিয়ে দেখতে পারি এবং স্বীকার করতে পারি যে, হ্যাঁ, সত্যিই কোথাও ওখানে কিছু আছে। সৌন্দর্য হলো এক নির্মাণ, আশার ও উচ্চতর শৃঙ্খলার এক জটিল সৃষ্টি।

হারি কুনজরু: আমরা আগেও আলোচনা করেছি যে সাহিত্যিক চরিত্ররা কীভাবে লেখকের মাধ্যমে জগতে উপস্থিত সত্তা হিসেবে জন্ম নেয়। দ্য প্যারিস রিভিউ-এর এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, “যে চরিত্রগুলোকে আমরা চিরস্থায়ী বা অনন্ত সাহিত্য বলে ভাবি, তারা সকলেই এসেছে সাধারণ মানুষদের মধ্য দিয়ে। এটি এক গোপন প্রক্রিয়া, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এটি সত্য।” আপনি কি এ বিষয়ে আরও কিছু বলতে পারেন?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি এখন শুধু এটুকুই বলতে পারি, কেবলমাত্র সাধারণ মানুষই বিদ্যমান। আর তারা পবিত্র।
-----------------

[হারি কুনজরু মূলত বৃটিশ ঔপন্যাসিক। এ পর্যন্ত সাতটি উপন্যাস লিখেছেন, সর্বশেষ উপন্যাসটি হচ্ছে "ব্লু রুইন"। তিনি নিয়মিতভাবে হার্পার্স, দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ-তে লেখেন।]

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ