নেত্রকোণার মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজের ৭৮তম জন্মদিন যেন এক আলোকিত স্মৃতির উৎসব। মঙ্গলবার বিকেলে জেলা শহরের দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, যেখানে কবি তাঁর ছাত্রজীবনের দিনগুলো কাটিয়েছেন, হিমু পাঠক আড্ডার আয়োজনে এই দিন পালিত হয়েছে এক হৃদয়স্পর্শী আনন্দে। এই মুহূর্ত যেন শুধু একটি জন্মদিন নয়, বরং কবির কালজয়ী কবিতার মাধ্যমে জাগ্রত প্রেম, দ্রোহ আর মানবিকতার এক অমর উদযাপন।অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান কবির কবিতার গভীরতা ও সমাজ জাগানিয়া শক্তির কথা তুলে ধরেন, যেন হেলাল হাফিজের লেখনী এখনো আমাদের হৃদয়ে দ্রোহের আগুন জ্বালায়। স্মৃতিচারণে অংশ নেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুখময় সরকার, শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুজিত কুমার সাহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী, সিনিয়র সাংবাদিক শ্যামলেন্দু পাল, লেখক প্রফেসর ননী গোপাল সরকার, প্রাবন্ধিক স্বপন পাল এবং হিমু পাঠক আড্ডার প্রতিষ্ঠাতা আলপনা বেগম। তাদের কথায় ফুটে ওঠে কবির জীবনের নানা অধ্যায়—যৌবনের উত্তাল দ্রোহ থেকে প্রেমের নরম স্পর্শ, যা তাঁর কবিতায় মিশে এক অপূর্ব সুর সৃষ্টি করেছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবির কবিতাগুলো যেন নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে, তাদের মনে জাগিয়েছে এক অদম্য উৎসাহ।
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণার আটপাড়ার বড়তলী গ্রামে জন্ম নেওয়া হেলাল হাফিজ ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) পাঠকের হৃদয়ে তীব্র আলোড়ন তুলেছিল। ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘কবিতা একাত্তর’ এবং ২০১৯ সালে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ তাঁর সৃষ্টির গভীরতাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। অল্প কবিতায় অসীম জনপ্রিয়তা অর্জন করা এই কবি ২০২৫ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন, যা তাঁর ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের এক অমর স্বীকৃতি।
হেলাল হাফিজের কবিতা শুধু শব্দ নয়, একটি প্রজন্মের জাগরণের মশাল। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার সেই অমোঘ ছত্র—“এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”—ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হেলাল হাফিজের কলম থেকে যেন দ্রোহের আগুন ঝরে পড়েছিল। এই কবিতা আজও তরুণদের রক্তে উত্তেজনা জাগায়, তাদেরকে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা দেয়।নেত্রকোণার এই জন্মদিন উৎসবে কবি হেলাল হাফিজের স্মৃতি যেন এক জ্বলন্ত মশাল হয়ে উঠেছে, যা প্রেমের নরম আলোয় এবং দ্রোহের তীব্র আগুনে সমাজকে আলোকিত করে চলেছে। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে বেঁচে আছে, তাদেরকে শিখিয়ে চলেছে—প্রেমে জাগো, দ্রোহে জ্বলো, আর জীবনকে গড়ো এক অপার সম্ভাবনার ক্যানভাসে।

