বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জুলাই সনদকে ঘিরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন—“জুলাই সনদ নিয়ে সমঝোতায় আসতেই হবে”। আবার তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “দ্বিমতের জায়গা নেই”। প্রশ্ন হলো—এমন বক্তব্য কি স্বৈরাচারী ভঙ্গি, নাকি দেশের অনিবার্য বাস্তবতার প্রতি এক কঠিন সতর্কবার্তা?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশে নতুন এক রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। এই অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পতন নয়, একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম দিয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতেই জুলাই সনদ প্রণয়ন। এতে মূলত রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সংস্কারের একটি ন্যূনতম কাঠামোতে সম্মত হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচারী শক্তি সহজে ক্ষমতা দখল করতে না পারে।
এই সনদের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, “স্বৈরাচার আসার সব পথঘাট বন্ধ করতে হবে”। আবার তিনি নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের নির্বাচন হবে জাতির নবজন্মের এক মহোৎসব। তার মতে, এই নবজন্ম তখনই সম্ভব যখন সবাই জুলাই সনদের ভিত্তিতে একমত হবে।
প্রথমত, ড. ইউনূসের বক্তব্যে কোনো বিকল্পের জায়গা নেই। তিনি বলেছেন—“এ সমঝোতায় আসতেই হবে”। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম ভিত্তি হলো বহুমত ও ভিন্নমতের স্বীকৃতি। সেখানে “দ্বিমতের জায়গা নেই” ধরনের উক্তি শোনায় কর্তৃত্ববাদী।
দ্বিতীয়ত, তিনি যেন একপ্রকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণ ও রাজনীতিবিদদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এতে মনে হতে পারে যে, ভিন্ন মত প্রকাশ করলে তা অগ্রাহ্য হবে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিটি দল নিজেদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করে। সেখানে “সবাইকে একমত হতে হবে” কথাটি এমনভাবে বলা হলে অনেকে একে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত করার প্রয়াস হিসেবে ধরতে পারেন।
তবে অন্য দিক থেকেও দেখা দরকার। স্বৈরাচারের মূলে থাকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ইচ্ছা। কিন্তু ড. ইউনূসের বক্তব্যে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ধরে রাখার কোনো ইঙ্গিত নেই। তিনি বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে গণতান্ত্রিক পরিবেশে সমঝোতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি গড়তে চাইছেন।
তাঁর যুক্তি হলো—যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে দেশের মধ্যে অস্থিরতা আবারও বিস্ফোরিত হবে। তখন পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং স্বৈরাচার ফেরার ঝুঁকি তৈরি হবে। সুতরাং তার বার্তাটি মূলত রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করা, যাতে তারা অহেতুক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সুযোগ নষ্ট না করে।
আরেকটি বিষয় হলো, তিনি বারবার বলেছেন এই প্রক্রিয়া হবে “বিশ্বের জন্য নজির”। অর্থাৎ, এটি কেবল দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও একটি উদাহরণ হয়ে উঠুক—এটাই তার অভিপ্রায়। স্বৈরাচারী শাসকরা কখনোই নিজেদের কাজকে বিশ্বে নজির বানানোর আহ্বান দেন না।
বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝাতে এখানে একটি তুলনামূলক টেবিল রাখা যেতে পারে—সমঝোতা ছাড়া দেশে স্থিতি ফিরবে না। তাই “আসতেই হবে” ভাষা হলো বাস্তবতার কড়া নির্দেশনা। “আসতেই হবে” শব্দচয়ন গণতান্ত্রিক বহুমতকে অস্বীকার করে, যা স্বৈরাচারী ভঙ্গি। উদ্দেশ্য হলো স্বৈরাচার রোধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিশ্চিত করা। ভিন্নমত বা বিকল্প আলোচনার সুযোগ সীমিত করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“দ্বিমতের জায়গা নেই” মানে জাতীয় স্বার্থে মৌলিক সংস্কার নিয়ে বিরোধিতা করা যাবে না। আবার “দ্বিমতের জায়গা নেই” মানে ভিন্নমত দমন—যা একনায়কসুলভ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে জুলাই সনদ একটি জাতীয় ঐকমত্য—এতে সবাই মিলে একমত হলে দেশ 'নবজন্ম' পাবে। কিন্তু ঐকমত্য চাপিয়ে দিলে তা টেকসই হবে না; বরং বিরোধী পক্ষ আরও ক্ষুব্ধ হবে।
গণতন্ত্র মানে কেবল ভিন্নমতের স্বাধীনতা নয়, বরং কখনো কখনো জাতীয় স্বার্থে একক নীতি মেনে নেওয়াও জরুরি। ড. ইউনূসের বক্তব্যে সেই জাতীয় স্বার্থের দিকটিই বেশি জোরালো। তবে তিনি যেভাবে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাতে কর্তৃত্ববাদী সুর চলে এসেছে। এই সুর এড়িয়ে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষা ব্যবহার করলে বার্তাটি আরও গ্রহণযোগ্য হতো। যেমন, “আমরা সবাইকে নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাই” বললে তা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক শোনাতো।
পরিশেষে বলা যায়—ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য স্বৈরাচারী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, বরং স্বৈরাচার ঠেকানোর এক জরুরি সতর্কবার্তা। তবে তার ভাষার দৃঢ়তা ও চাপ সৃষ্টিকারী ভঙ্গি অনেকের কাছে স্বৈরাচারী ঢঙে মনে হতে পারে। এখন দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর—তারা কি এই বক্তব্যকে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যবহার করবে, নাকি সত্যিই জাতির নবজন্মের সুযোগকে কাজে লাগাবে? ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে সুযোগ একবার এলে সেটি হাতছাড়া করলে দীর্ঘ সময়ের জন্য আফসোস বয়ে বেড়াতে হয়।

