নেপালের ইতিহাসে ১৯৭৩ সালের বিমান ছিনতাই কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং এটি এক নারীর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে অনিচ্ছাকৃতভাবে জড়িয়ে যায়। সেই নারী বলিউডের শীর্ষ অভিনেত্রী মালা সিনহা। তিনি ছিলেন সেই বিমানের যাত্রী, যেটি নেপালি কংগ্রেসের তরুণ কর্মীরা ছিনতাই করেছিলেন। ছিনতাইকারীদের মধ্যে ছিলেন দুর্গা প্রসাদ সুবেদি—যিনি পরবর্তীতে নেপালের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কির স্বামী।
এই অতীত আজ আবার আলোচনায়। কারণ, সরকার পতনের পর সুশীলা কার্কির প্রধানমন্ত্রী হওয়া রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করেছে, আর সোশ্যাল মিডিয়া নতুন করে টেনে এনেছে মালা সিনহার নাম।
১৯৭৩: নেপালের প্রথম বিমান ছিনতাই
১০ জুন, ১৯৭৩। বিরাটনগর থেকে কাঠমাণ্ডু যাচ্ছিল রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের ১৯ আসনের একটি ছোট্ট বিমান। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন মালা সিনহা ও তাঁর স্বামী, নেপালি অভিনেতা সি.পি. লোহানি। হঠাৎ তিন তরুণ কংগ্রেস কর্মী ককপিট দখল করে বিমানটিকে ছিনতাই করেন। তাদের নেতা ছিলেন দুর্গা সুবেদি। উদ্দেশ্য ছিল বিপুল অঙ্কের অর্থ ছিনিয়ে এনে পার্টির আন্দোলনকে তহবিল দেওয়া। নগদ ৩০ লাখ রুপি ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যা তখনকার সময়ে অকল্পনীয় অঙ্ক।
এই অভিজ্ঞতা মালা সিনহার জীবনে ছিল এক গভীর ট্রমা। যদিও তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবুও তাঁর নাম সেই ইতিহাসের সঙ্গে অযথাই জড়িয়ে যায়।
১৯৭৮: মালার বাথরুম থেকে উদ্ধার ১২ লাখ টাকা
এর পাঁচ বছর পর, আরেকটি বিতর্ক মালা সিনহাকে আঘাত করে। আয়কর দপ্তর তাঁর বাড়ি থেকে ১২ লাখ রুপি উদ্ধার করে। টাকার উৎস ব্যাখ্যা করতে না পেরে তিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। সেখানেই তিনি এক চমকপ্রদ বক্তব্য দেন—“আমি দেহব্যবসা করে টাকা উপার্জন করেছি।”
পরে জানা যায়, এটি ছিল তাঁর বাবার ও আইনজীবীর পরামর্শ; আসল উদ্দেশ্য ছিল আইনি ফাঁদ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা। আদালত তাঁকে জরিমানা করল, কিন্তু সেই এক বাক্য তাঁর সারা জীবনের ইমেজকে কলঙ্কিত করল। একজন শীর্ষস্থানীয় নায়িকা, যিনি পর্দায় ছিলেন হাজারো নারীর প্রেরণা, তাঁকে “পতিতা” শব্দের বোঝা বইতে হলো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
সুশীলা কার্কির বর্তমান ও দায়ের প্রশ্ন
আজ, নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কার্কির উত্থান নিঃসন্দেহে দেশটির জন্য একটি মাইলফলক। তবে তাঁর স্বামী দুর্গা সুবেদির অতীত ছিনতাই–ইতিহাস নতুন করে আলোচনায় এনেছে মালা সিনহার নাম। প্রশ্ন উঠছে—একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি কি নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ নন যে, তাঁর স্বামীর সেই ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মালার কাছে ক্ষমা চাইবেন?
কারণ, মালা আজ নেই (তিনি ২০২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন), কিন্তু তাঁর সুনামের ওপর যে দাগ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা মুছে যায়নি। নেপালের ইতিহাসে তাঁর নাম একজন যাত্রী হিসেবে নয়, বরং একটি বিতর্কের চরিত্র হিসেবে জড়িয়ে রয়ে গেছে।
সামাজিক দায় ও দ্বিমোচন
আমাদের সমাজে নারীরা প্রায়ই অন্যায়ের দায় বইতে বাধ্য হন। মালা সিনহা কোনো অপরাধ করেননি—না বিমান ছিনতাইয়ে, না কর ফাঁকিতে। কিন্তু তিনি যে দুটি ঘটনায় নাম লিখিয়েছিলেন, তাতে তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
আজ নেপাল সরকার চাইলে একটি প্রতীকী পদক্ষেপ নিতে পারে—
মালা সিনহার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে দুঃখ প্রকাশ।
স্পষ্ট ঘোষণা যে বিমান ছিনতাই ঘটনায় তিনি কেবল একজন যাত্রী ছিলেন, ভুক্তভোগী ছিলেন।
তাঁর ১৯৭৮ সালের বিতর্ককে পুনর্বিবেচনার আহ্বান, যেখানে আদালতে দেওয়া বক্তব্য ছিল ভ্রান্ত ও চাপের ফল।
পরিশেষে বলা যায়, অতীতের ছায়া আজকের রাজনীতিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তবে এটি একইসঙ্গে একটি সুযোগও। নেপাল সরকার যদি মালা সিনহার প্রতি ন্যায়বিচারের প্রতীকী স্বীকৃতি দেয়, তবে কেবল একজন অভিনেত্রীর স্মৃতিই মুক্ত হবে না, বরং নারীর প্রতি সমাজের অন্যায় দায় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও একটি শক্ত বার্তা যাবে।
মালা সিনহা আমাদের মনে থাকবেন তাঁর চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে, কোনো ছিনতাইয়ের যাত্রী কিংবা আদালতের কাঠগড়ায় “অভিযুক্ত নারী” হিসেবে নয়।

