চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রূপ নিয়েছিল রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের মঞ্চে। আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) হাতে শিক্ষাঙ্গন পরিণত হয়েছিল দমন–পীড়নের পরীক্ষাগারে, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে ধারালো অস্ত্র ও বন্দুকই ছিল প্রধান হাতিয়ার। ফলাফল—অন্তত সাতটি হত্যাকাণ্ড, শত শত সংঘর্ষ, এবং হাজারো সাধারণ ছাত্রকে ‘শিবির সন্দেহে’ হেনস্তা।
মিডিয়ার নথি ও সংগঠনগুলোর দাবি বলছে, এই সময়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের (আইসিএস) পাঁচ নেতাকর্মী খুন হন বিসিএলের হাতে। ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে চৌধুরীহাট, জিরো পয়েন্ট থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল—সবখানেই ছড়িয়ে ছিল রক্তের দাগ। ২০১০ সালের ১১ মার্চ মহিউদ্দিন মাসুমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, আর একই বছরের ২৮ মার্চ ট্রেন থেকে নামিয়ে খুন করা হয় হারুন অর রশিদ কায়সারকে। ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একই দিনে মুজাহিদুল ইসলাম ও মাসউদ বিন হাবিবকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে গলা কেটে খুন করা হয় মামুন হোসাইনকে। অথচ কোনো মামলারই সুরাহা হয়নি—বিচার তো দূরের কথা, অনেক সময় মামলা পর্যন্ত নেয়নি পুলিশ।
বিসিএল নিজ দলের নেতাদেরও রেহাই দেয়নি। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র তাপস সরকার গুলিতে নিহত হন, আর ২০১৬ সালের নভেম্বর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে টেন্ডার ও গ্রুপিং রাজনীতির বলি হতে হয়। তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হলেও পরে ময়নাতদন্তে হত্যার প্রমাণ মেলে। দিয়াজের মা জাহেদা চৌধুরী এখনও বিচারের জন্য লড়ছেন।
এদিকে বিএনপি-সমর্থিত ছাত্রদল নিয়মিতভাবে হামলার শিকার হয়। তাদের নেতাদের মিছিল ভাঙা, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, ক্লাস থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করা, এমনকি পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০১৮ সালে সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়কে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায় বিসিএলের কর্মীরা। শহীদুল ইসলাম শহীদসহ শীর্ষ নেতাদের উপর প্রকাশ্যে হামলা চালানো হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল শিবির ট্যাগ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হেনস্থা। ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অন্তত এক হাজারের বেশি ছাত্রকে সন্দেহের বশে মারধর করা হয়, অনেককে রুম থেকে বের করে নির্যাতন করা হয়, বহুজন আজীবন মানসিক আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছেন। আলাওল হল, এএফ রহমান হল, কিংবা ক্যাম্পাসের কলা অনুষদ—সব জায়গাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
এই সহিংসতার পেছনে প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। মামলার পরিবর্তে উল্টো ভিকটিমদের গ্রেপ্তার, প্রক্টরিয়াল টিমের নীরবতা, আর পুলিশের নির্বিকার মনোভাব বিসিএলকে দিয়েছিল ‘ইমিউনিটি’। দ্য ডেইলি স্টার ২০১৯ সালের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিল: চবি ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ডে “নো পানিশমেন্ট” সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর যখন দেশজুড়ে ছাত্র–জনতা আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে ফেটে পড়ে, তখন চবিতে বিসিএল ও পুলিশ একসাথে মিছিল দমনে হামলা চালায়। সেই ঘটনার রক্তাক্ত স্মৃতি আজও তাজা। এর কয়েক মাস পর ২৩ অক্টোবর ২০২৪ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিসিএলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যতক্ষণ না অতীতের হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার হবে, নিহতদের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে, এবং শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক দখলদারি থেকে মুক্ত করা হবে, ততক্ষণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস শিক্ষার জন্য নয়, বরং ত্রাসের প্রতীক হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এটি শুধু চবির গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক অন্ধকার অধ্যায়, যেখানে শিক্ষা পরিণত হয়েছিল রক্তের দাগে লেখা যুদ্ধের ক্যানভাসে।

