logo
ads

৬২’র শিক্ষা আন্দোলন: ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

প্রকাশকাল: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:২২ পি.এম
৬২’র শিক্ষা আন্দোলন: ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা

ফাইল ছবি

ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে কিছু তারিখ থাকে, যেগুলো রক্তে লেখা, অঙ্গীকারে অটল, আর ভবিষ্যতের জন্য পথের দিশারী হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর তেমনই এক তারিখ। শিক্ষার মুক্তি ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এই দিনটি হয়ে উঠেছিল আলোকবর্তিকা। শরীফ কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে উত্তাল ঢাকার রাজপথে পুলিশের বুলেটে ঝরে পড়েছিল তরুণ প্রাণ—বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ। তাঁদের রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল নতুন ভোরের আভাস, জাগিয়ে তুলেছিল বাঙালির সংগ্রামী চেতনাকে।

শিক্ষা কেবল বিদ্যা অর্জনের মাধ্যম নয়; শিক্ষা হলো আত্মমুক্তির, মানুষের মুক্তিস্বপ্নের মহাসোপান। অথচ সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিণত করতে চেয়েছিল শোষণের শেকলে বাঁধা এক কারাগারে। বাংলার ছাত্রসমাজ তা মেনে নেয়নি। তারা বুঝেছিল—শিক্ষার স্বাধীনতা ছাড়া জাতির মুক্তি অসম্ভব। তাই বুক চিতিয়ে নেমেছিল রাজপথে, সত্য ও স্বাধিকারের শপথ বুকে নিয়ে।

৬২’র শিক্ষা আন্দোলন ছিল ভাষা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ থেকে জ্বলে ওঠা আরেক অগ্নিশিখা, আর সেই শিখা পরবর্তীতে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত আলোকধারা তৈরি করেছিল। ছাত্রসমাজ প্রমাণ করে দিয়েছিল—বন্দুকের নল কিংবা সামরিক শাসকের শৃঙ্খল চিরকাল টিকতে পারে না; সত্য, অধিকার আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে।

কিন্তু আজ, দুঃখজনকভাবে, সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনের স্মৃতি রাষ্ট্রীয় পরিসরে প্রায় বিস্মৃত। পাঠ্যপুস্তকের পাতায় নেই যথাযথ স্থান, নেই প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার দায়বদ্ধতা। অথচ ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন কেবল একটি তারিখ নয়—এটি স্বাধীনতার পূর্বকথা, গণতন্ত্রের ঘোষণা, মুক্তচিন্তার অগ্নিবীজ।

বর্তমানেও শিক্ষাক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে দুঃশ্চিন্তার ছায়া। দলীয়করণ, বাণিজ্যিকীকরণ, আর মানহীনতার ঘূর্ণিপাকে শিক্ষা যেন এক অন্ধকার গলিপথে। পরীক্ষার ফলাফলে সোনালি অক্ষরে এ+ লেখা হলেও, জ্ঞানের ভিতরটা থাকে শূন্য। শিক্ষার অধিকার আজ অনেকটাই বাজারের পণ্যের মতো—যার টাকা আছে সে কিনতে পারে, যার নেই সে বঞ্চিত।

এখনই প্রয়োজন ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের চেতনায় ফিরে যাওয়া। প্রয়োজন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শিক্ষানীতি—যা হবে সমতার প্রতীক, মুক্তচিন্তার বাহক, জাতির উন্নয়নের সোপান।

১৭ই সেপ্টেম্বর আমাদের শুধু অতীত স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের অঙ্গীকারও হোক। সেই রক্তের দাগ মুছে যায়নি, সেই সংগ্রামের আহ্বান আজও স্পন্দিত। তাই শিক্ষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদের শপথ হোক—শিক্ষাকে আর কারও শোষণের হাতিয়ার হতে দেব না, শিক্ষা হবে কেবল মুক্তির আলোকবর্তিকা।

(লেখক : রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক)

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ