বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW)-এর এজেন্ট হিসেবে সন্দেহ করছে পুলিশ। নিজেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিলেও তা সম্পূর্ণ ভুয়া ও প্রতারণামূলক বলে নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিন্টো রোডে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, এবং আজ থেকে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (টাস্কফোর্স) তার আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।
ডিবি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত করিম স্বীকার করেছেন, তার সিআইএ এজেন্টের পরিচয় সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি দাবি করেন, ২০১৪ সালে তিনি বিএনপি ভাঙার একটি অ্যাসাইনমেন্টে জড়িত ছিলেন, যেখানে তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কিছু কর্মকর্তা এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করেছিলেন। তবে এই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এবং এটি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এনায়েত আরও জানান, তিনি রাজনীতি, ব্যবসা, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ১৪ জন ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। এই কাজে তিনি দেড় কোটি টাকা ব্যয় করেছেন বলে দাবি করেন। এছাড়া, ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ বনানীর শেরাটন হোটেলে ‘ইনসাফ কায়েম কমিটি’র একটি অনুষ্ঠানের খরচ বহন করেছিলেন বলে জানান, যদিও এই তথ্যের কোনো স্বাধীন সূত্রে নিশ্চিতকরণ পাওয়া যায়নি।
প্রতারণার ধরন ও রাজনৈতিক তৎপরতা
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এনায়েত করিম বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সুযোগ নিয়ে কার্যক্রম চালাতেন। তিনি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে এসে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করতেন। পুলিশের দাবি, তৎকালীন ডিজিএফআই তাকে ভাড়াটে হিসেবে ব্যবহার করেছিল। গত ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন এবং আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এই অভিযোগের তদন্ত করছে, বিশেষ করে তার সম্ভাব্য ভূমিকা একটি ‘ওয়ান ইলেভেন’ ধাঁচের সরকার গঠনের ষড়যন্ত্রে।
গ্রেপ্তার ও তদন্ত
১৩ সেপ্টেম্বর মিন্টো রোডে একটি প্রাডো গাড়িতে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময় এনায়েত করিম ও তার সহযোগী এস এম গোলাম মোস্তফা (আজাদ)কে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজেকে সিআইএ-এর পরিচালক হিসেবে দাবি করলেও, পুলিশ তার জাল নথি উদ্ধার করে। দুইটি আইফোন থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানায় ডিবি। গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রথমে ২ দিন এবং পরে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। বর্তমানে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও অস্বীকৃতি
জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত দাবি করেছেন, তার সঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম, সাবেক ডিজিএফআই মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) তাবরেজ শামস ও সাইফুল আলম, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি, জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিএনপির সাবেক অফিস সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ ও সাখাওয়াত হোসেন বকুলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তবে এই ব্যক্তিদের অধিকাংশই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জিএম কাদের ফোন কেটে দেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, শুধু একবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে দেখা হয়েছিল। শওকত মাহমুদ ও মফিকুল হাসান তৃপ্তি জানান, তারা এনায়েতকে চেনেন না। ইলিয়াস কাঞ্চন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারের চিকিৎসাধীন থাকায় তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রতারণার কৌশল ও অর্থ লেনদেন
তদন্তে উঠে এসেছে, এনায়েত করিম দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও জাল সিআইএ নথি তৈরি করে বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে নিজেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতেন। তিনি মোবাইলে স্ক্যান করা জাল নথি পাঠিয়ে প্রতারণা করতেন। পুলিশ জানায়, তিনি কখনো ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করেননি; বরং সহযোগী এস এম গোলাম মোস্তফা (আজাদ), যিনি একাত্তর টিভির সাবেক জিএম অপারেশন ছিলেন, তার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে টাকা লেনদেন করতেন। এনায়েত তাকে মাসিক ২ লাখ টাকা বেতনে সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই প্রতারণার ফলে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলেও পুলিশের তথ্য।
পূর্ববর্তী গ্রেপ্তার ও প্যাটার্ন
এনায়েতের কার্যকলাপে একটি সুস্পষ্ট প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে একই ধরনের প্রতারণা ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সে সময় তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। বর্তমান তদন্তে তিনি এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ও তিনি বাংলাদেশে এসে ফান্ড সংগ্রহ করেছেন বলে পুলিশ জানায়, যদিও এই সময়ে গ্রেপ্তারের কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতারণার ইতিহাস: একটি সংক্ষিপ্ত ওভারভিউ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস স্বাধীনতার পর থেকে (১৯৭১) প্রতারণা, দুর্নীতি, নির্বাচনী জালিয়াতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা চিহ্নিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৪ সালের কারাপশন পারসেপশন ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে রয়েছে, যা রাজনৈতিক দুর্নীতির গভীরতা নির্দেশ করে। এই চক্রাকার প্রক্রিয়ায় দলীয় স্বার্থ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে এবং জনগণের আস্থা হ্রাস পেয়েছে।
১৯৭১-১৯৭৫ (স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাট ও একদলীয় শাসন): মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিক শূন্যতায় সর্বজনীন লুটপাট শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে অন্যান্য দল নিষিদ্ধ করেন, যা গণতন্ত্রের প্রথম বড় আঘাত ছিল। এটি জনগণের অসন্তোষ বাড়ায় এবং ১৯৭৫-এর অভ্যুত্থান ও মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পথ প্রশস্ত করে।
১৯৭৫-১৯৯০ (সামরিক শাসন): জিয়াউর রহমান (১৯৭৫-৮১) ও এরশাদের (১৯৮২-৯০) আমলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। এরশাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সংস্কারে দুর্নীতি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৯০-এর গণআন্দোলন এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
১৯৯১-২০০৬ (দ্বিদলীয় যুগ): খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসনকালে হারিস চৌধুরীর মতো দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। ২০০৬-এর নির্বাচনী সংকটে সামরিক-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যা দুর্নীতি দমনের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চালায়।
২০০৯-২০১৩ (বড় স্ক্যান্ডাল): হাসিনা সরকারে হ্যালমার্ক গ্রুপ ৩৫০০ কোটি টাকা লুট করে, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি (২০১০-১১) এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফান্ড বাতিল করে। এটি অর্থনৈতিক ক্ষতি ও জনগণের অসন্তোষ বাড়ায়।
২০১৪-২০১৮ (নির্বাচনী জালিয়াতি): ২০১৪ সালে বিএনপির বয়কটে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে, যেখানে "ডামি" প্রার্থী ও ভোটার হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ২০১৮-এর "রাতের ভোট" নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৯৬% আসন জিতে, যাকে আন্তর্জাতিকভাবে "ফার্সিকাল" বলা হয়।
২০২০ (নির্বাচন কমিশন স্ক্যান্ডাল): ২০ কোটি টাকা কাল্পনিক প্রোগ্রামে খরচ এবং ৪০.৮ কোটি টাকা কর্মী নিয়োগে জালিয়াতি কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।
২০২৪ (জুলাই বিপ্লব): কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকারবিরোধী প্রতিবাদে ৮০০-এর বেশি মানুষ নিহত। হাসিনা পালিয়ে যান, এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটের অভিযোগ ওঠে, এবং হিন্দু ও বিএনপি কর্মীদের ওপর হামলা হয়।
এই দুর্নীতির মূল কারণ হলো রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র (শেখ-জিয়া পরিবার), নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা, ডিজিএফআই-এর মতো সংস্থার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সরকারি চুক্তিতে ঘুষ। ২০২৪-এর বিপ্লব আশা জাগালেও, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মতো সংস্কার ছাড়া দুর্নীতির চক্র অব্যাহত থাকবে।
পুলিশের বক্তব্য
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি ইলিয়াস কবীর জানান, “এনায়েত করিম একজন বড় মাপের প্রতারক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। আমরা তার দেওয়া তথ্য যাচাই করছি।” পুলিশ জানায়, এনায়েতের সঙ্গে অন্য কারও সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিশেষে বলা যায়, এনায়েত করিমের কার্যকলাপ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নেওয়ার একটি প্যাটার্ন প্রকাশ করে। তার ভুয়া সিআইএ পরিচয়, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ, এবং সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও রাজনৈতিক পরিবেশের একটি চিত্র তুলে ধরে। তদন্তের অগ্রগতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনী রোডম্যাপ এই ঘটনার গুরুত্ব নির্ধারণ করবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কভারেজ এবং আদালতের রায় এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

