logo
ads

ধর্মতলার দিল্লি বাবা : সাধুর পোশাকে লুকানো দানব

নিপুণ চন্দ্র

প্রকাশকাল: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৫ পি.এম
ধর্মতলার দিল্লি বাবা : সাধুর পোশাকে লুকানো দানব

সংগৃহীত

ছায়াময় আশ্রমের অন্ধকার কোণে, যেখানে ধূপের ধোঁয়ায় মিশে যায় অশ্লীলতার বিষাক্ত ফিসফিস, সেই বসন্তকুঞ্জের শ্রী শারদা ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ম্যানেজমেন্টের দরজা খুলে যায় এক অদৃশ্য জালের দিকে। “আমার ঘরে এসো... আমি তোমাকে বিদেশের স্বপ্নময় উড়ানে নিয়ে যাব, কোনো টাকা লাগবে না”—এমন মধুর বিষাক্ত বার্তা, যেন কালো মেঘের ছায়া, পাঠাতেন স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতী, যার আসল মুখোশ খুলে পড়ে পার্থসারথী নামে। দীর্ঘ ষোলো বছরের নির্যাতনের এই ছবি, যেন ভাঙা মন্দিরের দেওয়ালে লেখা রক্তাক্ত অক্ষর, অন্তত ১৭ জন কিশোরী শিক্ষার্থীর মোবাইলে ধরা পড়েছে—যারা অর্থনৈতিক দুর্বলতার ছায়ায় এসেছিল শিক্ষার আলো খুঁজতে, কিন্তু পেয়েছে অন্ধকারের গ্রাস। পুলিশের তদন্তে উন্মোচিত হয়েছে ৫০ জনের ওয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের সেই ভয়াবহ গল্প, যেখানে প্রলোভনের মধু মিশে আছে হুমকির বিষ। এই গডম্যানের চোখে ছিল শুধু ক্ষমতার লোভ, যা ধর্মের পবিত্র পোশাকে লুকিয়ে ছিল, কিন্তু এখন সেই পোশাক ছিঁড়ে পড়েছে, উন্মোচন করে এক দস্যুরাজের মতো নির্মমতা।

আশ্রমের দেওয়ালগুলো যেন নীরব সাক্ষী, যারা দেখেছে কীভাবে এই ‘স্বামী’ তার সাফরন রঙের ভোলভো গাড়ির জাল ডিপ্লোম্যাটিক নাম্বারপ্লেটের ছায়ায় লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতেন—যেন রাতের নিস্তব্ধতায় শিকারের সন্ধানে ছায়াময় বাঘ। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে একাধিক ভুয়া প্লেট, যা তার পলাতক জীবনের মানচিত্র আঁকছে: আগ্রার ধুলোময় রাস্তা থেকে লন্ডনের চকচকে আকাশপথ, সে পালাচ্ছে যেন ঝড়ের সামনে পাতা। ২০০৬, ২০০৯, ২০১৬ সালের পুরনো ক্ষতচিহ্ন—যৌন হেনস্থা, প্রতারণার অভিযোগ—যেন অসমাপ্ত অধ্যায়, যা কখনো তদন্তের আলোয় এসে ছিল না, কিন্তু এবার ৩২ জন শিক্ষার্থীর সাক্ষ্যে সেই অন্ধকার উঠে এসেছে। এই কিশোরীরা, যাদের চোখে ছিল স্বপ্নের ঝিলিক, তারা এখন ভয়ের ছায়ায় কাঁপছে; তাদের গল্প যেন ভাঙা ফুলের পাপড়ি, যা ছড়িয়ে পড়ছে আশ্রমের প্রতিটি কোণে। ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন (এনসিডব্লিউ) স্বয়ং সংক্রান্ত নোটিশ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে, তিন দিনের মধ্যে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছে—যেন বিদ্যুতের ঝলক, যা এই অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করবে।

কল্পনা করুন সেই দৃশ্য: আশ্রমের সাদা দেওয়ালে ধূপের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে কান্নার স্তব্ধতায়, যেখানে তিনজন মহিলা ওয়ার্ডেন—যেন নারী রূপ ধারণ করা দস্যুরানী, বা পতিতালয়ের মক্ষিকারানী যারা লোভের জাল বুনতে—শিক্ষার্থীদের চাপ দিতেন, হুমকি ছুড়তেন, ভয় দেখাতেন। এরা ছিলেন তার সহযোগী, যেন কালো রাতের ছায়াপথে চলা দল, যারা পরীক্ষার ফলাফলের ছুরি, বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভনের মধু, অর্থের ঝলক দিয়ে কিশোরীদের ফাঁদে ফেলতেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের মেয়েরা ছিলেন প্রধান শিকার—যেন নির্জন জঙ্গলে একা হরিণী, যারা মুখ খুলতে ভয় পেত, পরিবারের চাপে চুপ করে থাকত। এই ওয়ার্ডেনরা, নারী হয়েও নির্যাতনের হাতিয়ার, যেন বিষাক্ত ফুলের পাপড়ি যা সুন্দর দেখায় কিন্তু ছুঁলে মারাত্মক। তাদের চোখে ছিল শুধু ক্ষমতার লোভ, যা ধর্মের নামে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল, কিন্তু এখন তাদের কাজ উন্মোচিত হয়েছে যেন ঝড়ে উড়ে যাওয়া পর্দা। এই দৃশ্য যেন এক ভয়াবহ চিত্রকর্ম, যেখানে পবিত্রতার ছবিতে মিশে গেছে অশুচিতার কালো রেখা।

এই প্রতিষ্ঠান, স্রিঙ্গেরি শারদা পীঠামের শাখা যেন এক প্রাচীন বৃক্ষের ডাল, যা দক্ষিণ ভারতের পবিত্রতা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, কিন্তু এখানে তার শিকড়ে জড়িয়ে গেছে পৈশাচিকতার কালো ছায়া। পীঠাম নিজেই ঘোষণা করেছে: অভিযুক্তকে ‘অযোগ্য, অবৈধ, পীঠের স্বার্থের ক্ষতিকর’ বলে সরিয়ে দিয়েছে সব দায়িত্ব থেকে—যেন বিষাক্ত ফল কেটে ফেলা হয়েছে গাছ থেকে। কিন্তু এর আগে কতকাল এই কালো ছায়া ছড়িয়েছে? ধর্মের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার, যেন এক অন্ধকার মন্দির যেখানে দেবতার মূর্তির পিছনে লুকিয়ে আছে রক্ষসের হাসি। এই গডম্যানের মতো অনেকেই—যেমন আসারাম বাপু, যাকে ২০১৮ সালে ১৬ বছরের এক কিশোরীর ধর্ষণের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে, বা গুরুমিত রাম রহিম, যার আশ্রমে নারীদের নির্যাতনের গল্প যেন রক্তাক্ত পাতা—ধর্মের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। নিত্যানন্দের স্ক্যান্ডাল, যেখানে অভিনেত্রীর সাথে যৌনতালের ভিডিও উন্মোচিত হয়, বা সত্য সাঈ বাবার অভিযোগ যেন পুনরাবৃত্তির চক্র, যা ভারতের আশ্রমগুলোকে পরিণত করেছে নির্যাতনের গোপন কক্ষে। এই গডম্যানরা যেন কালো মেঘ, যারা বৃষ্টির নামে বিষ ঢেলে দেয়, কিশোরীদের স্বপ্ন ছিন্ন করে।

এখন প্রশ্ন উঠছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীরে, যেখানে শিশুকন্যাদের ধর্ষন আর শিশুবালকদের বলাত্কার যেন অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র। ভারতে, ২০০৭ সালের মিনিস্ট্রি অফ উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্টের স্টাডিতে দেখা গেছে, ৫৩% শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার, যার মধ্যে ৫০% ছেলে—আর এর অনেকটা ঘটে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। উদাহরণ? ক্যাথলিক চার্চের গ্লোবাল স্ক্যান্ডাল, যেখানে ১০,০০০ শিশুর ওপর পুরোহিতদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছে—কেরালায় পাদ্রিদের বিরুদ্ধে মামলা, মুম্বাইয়ে পেন্টেকোস্টাল চার্চের পাস্তর রাজকুমার যেসুদাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিশু নির্যাতনের জন্য। হিন্দু আশ্রমে স্বামী অখণ্ডানন্দ সরস্বতীর অভিযোগ, যেখানে ১৯৭০-৮০ এর দশকে অস্ট্রেলিয়া আর ভারতে শিশু-নারী নির্যাতনের গল্প উঠে এসেছে। এই ক্ষতির ছবি যেন ভাঙা পুতুলের চোখ—শিশুরা মানসিক আঘাতে ভেঙে পড়ে, আত্মহত্যার ছায়ায় ঢেকে যায়, সমাজের কোণে লুকিয়ে থাকে যেন ভয়ার্ত ছায়া। ধর্মের নামে এই পৈশাচিকতা, যেন বিষাক্ত নদী যা পবিত্রতার নামে বয়ে যায়, কিন্তু তার তীরে শুধু মৃত্যুর স্তূপ। গ্লোবালি, রয়্যাল কমিশন ইনটু ইনস্টিটিউশনাল রেসপন্সেস টু চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজে দেখা গেছে, ৫৮% ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জড়িত, যেখানে শিক্ষা আর ভয় মিশে যায় নির্যাতনের জালে। এই শিশুরা, যাদের হাসি ছিল ভবিষ্যতের আলো, তারা এখন অন্ধকারের কয়েদি—যেন ফাটল ধরা আয়নায় ভাঙা প্রতিবিম্ব।

এই চিত্র যেন এক ঝড়ো সমুদ্রের ঢেউ, যা আশ্রমের দেওয়াল ভেঙে ফেলছে, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কালো গহ্বর। সত্য সাঈ বাবার পুত্তাপর্থি আশ্রমে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ, যা ইউনেস্কোর সাথে ইভেন্ট বাতিল করে দিয়েছে; বা রামপালের হিসার আশ্রম, যেখানে হত্যা আর যৌন নির্যাতনের গন্ধ মিশে ছিল। এই গডম্যানরা যেন কালো জাদুর ছড়ি, যা ভক্তির নামে ছড়ায় ভয় আর লোভ। কিশোরী কন্যাদের ভোগের সেই সামগ্রী—যেন ভুলে যাওয়া দুঃস্বপ্নের পাতা—যাতে আর কখনো না হতে পারে, তার জন্য দরকার শক্তিশালী দেওয়াল, যেন আলোর বাঁধ। পুলিশের লুকআউট নোটিস যেন শিকল, কিন্তু সে পালাচ্ছে; আদালতের ধারা—যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেল, প্রতারণা, সাইবার আইনের ছায়া—যেন তীরের ঝড়, সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের হুমকি দিয়ে। কিন্তু এর বাইরে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যেন ভাঙা দুর্গের দেওয়াল—তাদের মানসিক সহায়তা, কাউন্সেলিং, সুরক্ষিত পরিবেশ দরকার, যেন নতুন সকালের আলো। প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে সতর্ক রক্ষক, ধর্মের নামে অপব্যবহারের দরজা বন্ধ করে।

এই গল্প যেন এক অসমাপ্ত ঝড়—দিল্লির এই স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতী, ধর্মের পোশাকে লুকানো দানব, কিশোরীদের শোষণ করে ক্ষমতার সিংহাসনে বসেছিলেন, কিন্তু এখন পলাতকতার ছায়ায় কাঁপছেন। পুলিশ, প্রশাসন, সমাজ—সবাইকে দাঁড়াতে হবে যেন অটল পাহাড়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করে, মানসিক ক্ষত সারিয়ে। এই অন্ধকার যেন শেষ হয় সকালের আলোয়, যাতে কোনো কিশোরী আর না কাঁদে আশ্রমের কোণে। ধর্ম হোক আলোর পথ, না কালো জালের ফাঁদ।

লেখক: নিপুণ চন্দ্র, মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান বাংলা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ