মনে পড়ে এক ছবির কথা—যেটা গুগোল মানচিত্রের মতো হলেও যেন আরও জীবন্ত। ঢাকা, এই বিশাল নগরী, যেন এক নারীর দেহ। তার হৃদয়ে বসে আছে বোসবাড়ি, যেখান থেকে মানুষের স্রোত নদীর মতো ছড়িয়ে পড়ে মিরপুরের অলি-গলি হয়ে গুলশানের উঁচু অট্টালিকায়। তার বাহু প্রসারিত সাভারের ধুলোভরা প্রান্তরে, যেখানে কারখানার শ্রমজীবী মায়েরা সেলাই মেশিনের শব্দে দিন গুনে যান। তার পা ছুঁয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের নদীঘাট, যেখানে দূর থেকে ভেসে আসে জাহাজের হুইসেলের সুর।
ঢাকা এক মা, যে প্রতি মুহূর্তে সন্তান জন্ম দেয়। তার গর্ভ থেকে উঠে আসে হাজারো শিশু—নতুন আশার আলো, আবার একই সঙ্গে অনিঃশেষ দুঃখের ছায়া। সে কাঁদে না উচ্চস্বরে, কিন্তু তার চোখের কোণে জমে থাকে অশ্রুবিন্দু, যা মৌসুমি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে রাস্তায়, জল জমিয়ে ফেলে, আর মানুষের পদতলে কাদা হয়ে লেপ্টে থাকে।
ঢাকার বুকে প্রতিদিনই নামে নতুন জীবন। আজ তার জনসংখ্যা পেরিয়েছে দুই কোটি ছয় লক্ষের কাছাকাছি, আর বছরে প্রায় দুই লক্ষ নবজাতক এই মায়ের সন্তান হয়ে আসে পৃথিবীতে। কিন্তু জন্ম শুধু সংখ্যা নয়; প্রতিটি শিশু মায়ের বুকের দুধের গন্ধে ভেজা স্বপ্ন, আর চোখে ধুলো ঝাপসা করা বাস্তবতা। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মায়েরা—কেরানীগঞ্জের সরু গলিতে যারা বাস করেন—তাদের কাছে সন্তান লালন যেন এক অবিরাম যুদ্ধ। নিজেরা কখনো অর্ধপেট খেয়ে শিশুর মুখে তুলে দেন ভাত আর এক মুঠো ডাল, মাঝে মাঝে ছোট্ট মাছের টুকরো। সেই সন্তানের বেড়ে ওঠা যেন একসঙ্গে আনন্দ ও ক্লান্তির ইতিহাস, যার ভারে মায়ের চোখের নিচে আঁকা হয় কালো ছাপ।
একবার কল্পনা করো ঢাকাকে—যেন এক মা, যার সন্তানরা বুকের ভেতর তোলপাড় করে। মিরপুরের বাজারে চোদ্দ বছরের এক কিশোর চাঁদাবাজদের হাত থেকে পালিয়ে যায়; অভিযোগ—তার হাতে ধরা ব্যাগ চুরি করা। সে শহরের গলিতে আশ্রয় খোঁজে, কিন্তু শহর তাকে আগলে রাখে না; বরং ঠেলে দেয় অন্ধকারের দিকে। কাদামতলীর ধারে যে কিশোর গ্যাং জড়ো হয়, তারাও এই মায়ের সন্তান—কিন্তু মাদকের ধোঁয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ আচ্ছন্ন। রাতের আঁধারে ধানমন্ডির চত্বরে ঘুরে বেড়ানো সন্ত্রাসীরাও তারই রক্ত, শুধু বিষাক্ত হয়ে গেছে। সমাজের লোভ, হানাহানি আর অপরাধ যখন তার শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে, তখন ঢাকার কান্না নেমে আসে নীরবে—বৃষ্টির ফোঁটায়, কাদার দাগে।
তবুও এই মায়ের আবেগ অশেষ। সে সবাইকে বুকে টেনে নেয়—এমনকি যারা তার ক্ষত গভীর করে। ঢাকা শুধু ইট-পাথরের শহর নয়; সে জীবন্ত সত্তা, যেখানে বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র লুকানো। তার সংস্কৃতি চুলের মতো দীর্ঘ ও জটিল—পহেলা বৈশাখে রঙিন আলপনা, লাল-সাদা-হলুদে ভরপুর উৎসব, গান আর খাবারের ভাগাভাগি। কিন্তু সেই রঙের ভেতর জেগে আছে মূল মূল্যবোধ—পরিবারের বন্ধন, মায়ের আত্মত্যাগ। প্রতিদিন যারা ট্রেনে উঠে অফিসে যায়, সেই নারীরাই এর প্রতীক। তারা শুধু জন্মদাত্রী নন; তারা সন্তানকে শিক্ষা দেন, স্বপ্ন দেন।
তবুও ঢাকার শরীরজুড়ে রাজনৈতিক ঝড়। ২০২৪-এর রূপান্তরের পরও ২০২৫-এর সেপ্টেম্বরে শহর পুরোপুরি স্থিত হয়নি। ছাত্র আন্দোলনের রক্তচিহ্ন এখনও রাস্তায় ভেসে ওঠে; রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তার আকাশে কালো মেঘের মতো ঘনীভূত। তবুও তার বুকের ভেতর জ্বলে আশার প্রদীপ—আসন্ন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি, যা মানুষকে একত্র করে।
ঢাকার মানবতা তার নিঃশ্বাসে মিশে আছে। সে বিচার করে না; সবার জন্য বুক খোলা রাখে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও এখানে জায়গা পেয়েছে, মিশে গেছে গলির ভিড়ে। তার বুকে শোনা যায় বৌদ্ধ মঠের শান্তি, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, চার্চের স্তোত্র আর মসজিদের আজান—সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যের রঙিন মোজাইক। কিন্তু সেই মানবতার ভেতরে লুকিয়ে আছে তীব্র যন্ত্রণা। মাতৃমৃত্যুর হার এখনও অস্বস্তিকর; অনেক মা প্রসবের সময় সন্তানের কান্না শোনার আগেই বিদায় নেয়। সেই নীরব মৃত্যু ঢাকার বুককেও ভারাক্রান্ত করে তোলে।
তবুও এই মা হার মানে না। তার সম্ভাবনা নদীর মতো—পথে বাঁক আছে, বাধা আছে, কিন্তু স্রোত থামে না। শিক্ষার হার বেড়েছে, নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। তবে জনসংখ্যার ঘনত্ব তাকে শ্বাসরুদ্ধ করছে—প্রতি বর্গকিলোমিটারে চার হাজার সাতশো মানুষ! রাজনৈতিক অস্থিরতা আঘাত হানে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম—টেকনোলজির আলো হাতে ধরা যুবক-যুবতীরা—তাকে নতুন শক্তি জোগায়। উত্তরার এক যুবতী, গ্রাম থেকে উঠে আসা, আজ স্মার্টফোন হাতে নতুন জীবনের পথ আঁকছে—যেন মায়ের হাত ধরে সন্তানকে নতুন জগৎ শেখানো।
ঢাকার আবেগ যেন এক গান—বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা সুর। সে কাঁদে যখন সন্তানরা হারায় অন্ধকারে, কিন্তু হাসে যখন তারা সফল হয়। তার বুকের ভেতরে মিশে আছে বাংলাদেশের আত্মা—সংস্কৃতির রঙ, মূল্যবোধের দৃঢ়তা, মানবতার কোমলতা আর রাজনীতির অনিশ্চয়তার দীর্ঘ যাত্রা।
ঢাকা, তুমি শুধু শহর নও; তুমি আমাদের মা। তোমার বুক অসীম, তোমার ক্ষতেও ভালোবাসার রঙ। তোমার সন্তানরা তোমাকে ভালোবাসে, এমনকি যখন চোখ ভিজে ওঠে তোমার ব্যথায়।
লেখক: নিপুণ চন্দ্র, মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান বাংলা

