logo
ads

আবৃত্তি সন্ধ্যা: এক স্মৃতির সুরেলা উদযাপন

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

প্রকাশকাল: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৭ পি.এম
আবৃত্তি সন্ধ্যা: এক স্মৃতির সুরেলা উদযাপন

নিজস্ব

যেন সন্ধ্যার আকাশে দুটি তারা মিলে জ্বলে উঠেছে—একদিকে নারীমুক্তির অগ্নিশিখা, অন্যদিকে সাহিত্যের অফুরন্ত নদী। এমনই এক অনুভূতির মিলনে টাঙ্গাইল শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় আবৃত্তির কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়ালো। নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায়ের প্রয়াণ দিবসে (১৯৩৩) এবং সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণবার্ষিকীতে (২০১৬) এই আয়োজনটি যেন দুই মহান আত্মার স্মৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তুলল। মাটির মা ফাউন্ডেশন, টাঙ্গাইল জেলা শাখার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই আবৃত্তি সন্ধ্যা ছিল কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং সাহিত্যের গভীরতায় ডুব দেওয়া এক অমৃতের স্পর্শ।
কামিনী রায়—যিনি ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার বাসণ্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন—তাঁর জীবন ছিল নারীজাগরণের এক জীবন্ত দলিল। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক হিসেবে তিনি বেথুন কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তৎকালীন সমাজে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল। মাত্র আট বছর বয়স থেকে কবিতা রচনা শুরু করে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে সাহিত্যের পথে অগ্রসর হন, কিন্তু তাঁর কলম ছিল নারীর অধিকারের অস্ত্র। স্বামীর অকালমৃত্যুর পরও তিনি নারীশ্রমিক তদন্ত কমিশনের সদস্যতা গ্রহণ করে সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে লুকিয়ে থাকে নারীর স্বাধীনতার আকুতি, যা আজও আমাদের হৃদয়স্পন্দনে প্রতিধ্বনিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক লাভ করে তিনি চিরকালের জন্য বাংলা সাহিত্যের আলোকবর্তিকা হয়ে থেকে যান।
আর সৈয়দ শামসুল হক—১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই 'সব্যসাচী লেখক'—তাঁর কলম ছিল বাংলাদেশের সমসাময়িকতার আয়না। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প—সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর পদচিহ্ন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনের বিবিসি বাংলা বিভাগে সংবাদ পাঠক হিসেবে তিনি বাঙালির স্বাধীনতার গান গেয়ে যান। 'একদা এক রাজ্যে' থেকে শুরু করে 'নিষিদ্ধ লোবান', 'তুমি সেই তরবারি'—তাঁর রচনায় মাটির গন্ধ মিশে থাকে মানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েও তিনি ছিলেন সেই সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর, যাঁর লেখায় মধ্যবিত্তের আনন্দ-দুঃখ একই সুরে বাজে। তাঁর চলে যাওয়া যেন বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যায়ের শেষ, কিন্তু তাঁর শব্দগুলো আজও জীবন্ত।
এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের স্মৃতিতে আয়োজিত আবৃত্তি সন্ধ্যায় কণ্ঠস্বরগুলো যেন তাঁদের অনুপস্থিতিকে পূর্ণ করে তুলল। প্রধান অতিথি ছিলেন বাদল চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, পদক্ষেপ বাংলাদেশ, ঢাকা। আলোচনায় অংশ নিলেন লুৎফর রহমান, নির্বাহী পরিচালক, ছায়ানীড় প্রকাশনী; রেখা আক্তার, সহকারী অধ্যাপক, কুমুদিনী সরকারি কলেজ; এবং গবেষক ড. আলী রেজা। তাঁদের কথায় কামিনী রায়ের নারীমুক্তির স্বপ্ন এবং শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধের রূপক যেন নতুন করে ফুটে উঠল, হৃদয়ে এক গভীর আলোড়ন জাগিয়ে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কাশিনাথ মজুমদার পিংকু, শিক্ষক ও সাংবাদিক; সৈয়দ সাইফুল্লাহ, পরিচালক, স্বরচিত আবৃত্তি একাডেমি; এবং আফরিনা হোসেন, প্রভাষক, কুমুদিনী সরকারি কলেজ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফিরোজ আহমেদ বাচ্চু, উপদেষ্টা, মাটির মা ফাউন্ডেশন। সাংগঠনিক রূপরেখা উপস্থাপন করেন হোসাইন মইন, প্রকাশনা সম্পাদক। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শামীম আল মামুন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন খন্দকার নিপুন, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, টাঙ্গাইল।
শিশু-কিশোর ও অভিভাবকদের জন্য উন্মুক্ত এই আয়োজনে স্থানীয়দের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। আবৃত্তির প্রতিটি লাইনে যেন কামিনী রায়ের সাহসী কণ্ঠ এবং শামসুল হকের অনুপ্রেরণাময় ছন্দ মিশে গেল। এমন অনুষ্ঠান যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাহিত্য কখনো মরে না—এটি জীবনের স্মৃতি, যা আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পার করি। টাঙ্গাইলের এই ছোট্ট প্রাঙ্গণে আজ একটা বড় স্বপ্ন জেগে উঠেছে, যা বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যতকে আলোকিত করবে।


 

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ